রামাদানের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে সর্বশেষ সয়ংসম্পূর্ণ নির্দেশিকা।
রামাদানের খাদ্যাভ্যাস
- লেখকঃ উস্তাদ আলী হাম্মুদা, মোহাম্মাদ ফারিস
- সম্পাদনা ও সংযোজনঃ মুওয়াহহিদ মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ
- রামাদানে ইবাদাত এবং নিজেকে কীভাবে আত্মিকভাবে আরাে পরিশুদ্ধ করা যায়, সেই চিন্তা না করে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই ৩০ দিন ইফতার ও সাহরিতে কী রান্না করবেন বা কী খাবার তৈরী করবেন তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন। রামাদানের এক বা দুই সপ্তাহ আগ থেকেই কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। কিছু মানুষ তাে রামাদানের প্রথম কয়েকদিনে চরম অমিতব্যয়ির মতাে খাবার বানান, অথচ চিন্তা করেন না পরবর্তীতে তা তাদের উপর কী প্রভাব ফেলবে; বিশেষত যখন তাদের দীর্ঘ তারাবিহর সালাতের জন্য দাঁড়ানাের প্রয়ােজন হবে।
- এই প্রবন্ধে রামাদানে একজন প্রােডাক্টিভ মুসলিমের খাদ্যাভ্যাস কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়ার চেষ্টা করা হবে। পাশাপাশি একটি বিশেষ ডায়েট প্ল্যান বানানাের রূপরেখা প্রণয়ন করা হবে যা মেনে চললে সিয়ামরত অবস্থায়ও আপনি সুস্থ থাকতে পারবেন ইনশাআল্লাহ। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হােন, আপনার এই রামাদান আরেকটি ভােজন-উৎসব হবে না। বরঞ্চ এই রামাদানে আপনি পরিমিত ও সুষম খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে আপনার স্বাস্থ্য এবং ওজনকে সঠিক অবস্থানে আনতে পারবেন, ইন শা আল্লাহ!
- মানবদেহে রোজার প্রভাব
যারা আগে কখনও রােজা রাখেন নি তারা হয়ত ভাববেন এটি খুবই প্রান্তিক ও কষ্টকর কিছু হবে। কিন্তু, রামাদানের প্রথম কয়েকদিন রােজা থাকার পরেই আপনার শরীর নতুন রুটিনে অভ্যস্ত হয়ে পড়বে এবং উপকারী বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পাদনে রত হবে।
আসলে আমাদের শরীর রােজা রাখার প্রক্রিয়া শুরু করে শেষ খাবার খাওয়ার অর্থাৎ, সাহরি খাওয়ার ৮-১২ ঘণ্টা পর থেকে, যখন সর্বশেষ ভােজনের সব পুষ্টিরস আমাদের পাকস্থলী শুষে নেয় তখন। শক্তি উৎপন্ন করার জন্য আমাদের দেহ প্রথমে কার্বোহাইড্রেট এবং তারপর জমা থাকা চর্বি ব্যবহার করে। যখন আপনি কিছুই না খেয়ে কয়েকদিন কাটিয়ে দিবেন তখন আপনার দেহ জমে থাকা প্রােটিন ব্যবহার করা শুরু করবে এবং মাংসপেশি বা মাসল ভাঙতে শুরু করবে।
তখন আপনি অনাহারের পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অন্যদিকে, রামাদানে রােজা রাখায় শারীরিক ক্ষতির তেমন সম্ভাবনা নেই, কারণ রােজা রাখা শুরু হয় ভােরবেলা থেকে আর রােজা ভাঙ্গা হয়ে যায় সূর্যাস্তের সময়ে।
উপরন্তু, রােজা রাখার ফলে মানবদেহে জমে থাকা চর্বি স্তর থেকে শক্তি উৎপন্ন করার উপকারী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়া স্বাস্থ্যকর উপায়ে ওজন কমায়, কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমায় এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে।
- সিয়াম হলাে প্রাকৃতিক বিষনাশক
রােজা রাখার আরেকটি উপকারিতা হল এটি ডিটক্সিফিকেশন তথা বিষনাশে সাহায্য করে। সহজভাবে বললে, আমাদের দেহে অনেক ক্ষতিকর উপাদান চবির সাথে জমে থাকে। চর্বি থেকে যখন শক্তি উৎপন্ন হয় তখন এসব ক্ষতিকর উপাদানগুলাে গলে যায় এবং আমাদের শরীরও দ্রুত আরােগ্য প্রক্রিয়া শুরু করে দেয়। রােজা রাখার ফলে মানবদেহে আরেকটি উপকার সাধিত হয়। তা হচ্ছে, এটি অধিক পরিমাণ শক্তিকে হজমক্রিয়ায় ব্যবহার না করে শরীরের রােগ প্রতিরােধ প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতে ব্যয় করে।
আপনি কি কখনাে খেয়াল করেছেন, রামাদানে আমাদের শরীর অনেক বেশি ঝরঝরে লাগে? কারণ, সিয়াম আপনার পরিপাকতন্ত্রকে বিশ্রাম দেয় এবং আপনার বিপাকক্রিয়াকে শক্তি যােগায়। ফলে তা আরাে কার্যকরভাবে শর্করা খরচ করতে পারে। যদি আপনার পরিপাক ক্রিয়া দুর্বল হয়, এটি আপনার খাদ্য বিপাক ক্রিয়ার সামর্থ্যে প্রভাব ফেলে এবং চর্বি খরচ করে।
সিয়াম আপনার পরিপাক ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্বাস্থ্যকর অস্ত্রক্রিয়ার প্রবর্তন করে। এভাবে আপনার বিপাক ক্রিয়াকে উন্নত করে। কিছু গবেষকের মতে, ‘শুধুমাত্র একদিন কিছু না খেলে, আমাদের শরীর বিষাক্ত পদার্থ পরিষ্কার করে ফেলে। এর ফলে শরীরের লিভার, কিডনিসহ অন্যান্ অঙ্গের কার্যক্ষমতা বাড়ে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ, নাথান হেউইট তার একটি প্রবন্ধে অনুরূপ কথাই বলেছেন।
যদিও সিয়ামের অনেক বেশি উপকারিতা রয়েছে, যা বৈজ্ঞানিকভাবেও প্রমাণিত; তবু, এটা ওজন কমানাের চুড়ান্ত সমাধান হতে পারে না। কারণ, আমাদের শরীরে ওয়াটার বড়ি রয়েছে যা কমলে শরীরের ওজন তাে আপাত কমে, কিন্তু এটি ওজন কমানাের চূড়ান্ত সমাধান নয়।
সিয়াম আপনার ওজন কমানাের প্রক্রিয়ায় একটি দ্রুত লম্বা পদক্ষেপ, কিন্তু এটিই চূড়ান্ত সমাধান নয়।
- সিয়াম যেভাবে স্বাস্থ্য ও সুস্থতা বাড়ায়
রামাদান শুধু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছাকাছি হওয়ার আত্মিক অভিযাত্রার নাম'ই নয়, এটি আপনার শারীরিকসুস্থতার যাত্রাশুরুর মাইলফলকও। সিয়ামের অসংখ্য শারীরিক উপকারিতা আছে, এটি আপনাকে আপনার খাবারদাবার পুনঃমূল্যায়ন করার ও খাদ্যাভ্যাসকে উন্নত করার একটি সুযােগ প্রদান করার মাধ্যমে আপনার ওজন কমানােতে সাহায্য করে।
খাদ্যাভ্যাস সম্পর্কে রাসূল (ﷺ) এর একটি একটি হাদিস উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে। নবীজি (ﷺ) বলেন, “মানুষ পেটের চেয়ে নিকৃষ্ট কোন পাত্র ভর্তি করে না। (যতটুকু খাদ্য গ্রহণ করলে পেট ভরে পাত্র থেকে ততটুকু খাদ্য উঠানাে কোন ব্যক্তির জন্য দৃষণীয় নয়)। যতটুকু আহার করলে মেরুদণ্ড সােজা রাখা সম্ভব, ততটুকু খাদ্যই কোন ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট। এরপরও যদি কোন ব্যক্তির উপর তার নফস (প্রবৃত্তি) জয়যুক্ত হয়, তবে সে তার পেটের এক-তৃতীয়াংশ আহারের জন্য, এক-তৃতীয়াংশ পানির জন্য এবং এক তৃতীয়াংশ শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য রাখবে।” [তিরমিযি, হাদিস-ক্রম :২৩৮০; ইবনু মাজাহ, হাদিস-ক্রম : ৩৩৪৯]
খাবারের ব্যাপারে অংশ ঠিক রাখার এই বিষয়টি আমাদের প্রিয় রাসূল (ﷺ) প্রায় ১৪০০ বছরেরও আগে পরামর্শ দিয়ে গেছেন, তখনও ওজন কমানাের এত উন্মাদনা শুরু হয়নি। আমরা যদি সত্যিই আমাদের রাসূল -এর এই সােনালি উপদেশ মেনে চলি, তাহলে আমরা নির্বোধের মতাে খাওয়া দাওয়া করবাে না এবং আমাদের পেট পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তা ভরতে থাকবাে না। কারণ, তা অবধারিতভাবেই ওজন বৃদ্ধি, অলসতা এবং ক্লান্তি নিয়ে আসে।
যারা সারাক্ষণ পানাহারের উৎসবে মেতে থাকে অথবা তাদের এই অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, সিয়াম পালন আপনার আত্মনিয়ন্ত্রণ বাড়াতে এবং আপনার খাদ্যাসক্তিকে কমিয়ে আনতে সাহায্য করবে। কেননা, তা আপনাকে শুধুমাত্র অনুমােদিত সময়ে খেতে বাধ্য করে। সেজন্য, আপনার শরীর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই সেই নবপরিবর্তনের সাথে অভ্যস্ত হয়ে যায়। প্রাকৃতিকভাবে, সিয়াম পালন আপনাকে এমন একটি পদ্ধতি খুঁজে পেতে ও মেনে চলতে সাহায্য করে, যেটা পরবর্তীতে অসুস্থদের জন্য স্বাস্থ্যকর, ইন শা আল্লাহ।
- ইন্টারমিটেন্ট ফাষ্টিং ওজন কমায়
কিছু নির্ধারিত সময়ে না খেয়ে থাকাকে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং বলে। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং শরীরের চর্বিসমৃদ্ধ কোষসমূহকে কার্যকরভাবেনষ্ট করে ফেলে, যা শুধু নিয়মিত নির্ধারিত খাদ্যতালিকা অনুসরণের মাধ্যমে সম্ভবপর হয় না। সুতরাং, সিয়াম বা না খেয়ে থাকাটা ওজন কমানাের একটা নিরাপদ উপায় হতে পারে। একদিন সিয়াম পালনের পর আপনার জন্য অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করাটা অধিক কার্যকরী, বিশেষত হৃৎপিণ্ড সংক্রান্ত ব্যাপারে।
আপনি সিয়ামবিহীন দিনের তুলনায় সিয়ামরত দিনে বেশি চর্বিসমৃদ্ধ কোষকে খরচ করছেন, কেননা, “ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ এ আপনার শরীর শর্করার পরিবর্তে চর্বিকে শক্তির প্রাথমিক উৎস হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমানে, এমনকি অনেক ক্রীড়াবিদেরাও খেয়ে থাকাটাকে প্রতিযােগিতার জন্য শরীরের চর্বি কমানাের উপায় হিসেবে খুঁজে পেয়েছেন।
- সিয়াম অনাহারে থাকা নয়
কিছু মানুষ এই গভীর অনুভূতি লালন করে যে, সিয়াম শরীরকে ক্ষুধার কষ্ট দেয় এবং আপনি তাই ‘ক্ষুধায় কাতর হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মতাে অবস্থায় চলে যান। এটি সত্য নয়। সিয়াম দিনের পর দিন অনাহারে থাকা নয়। এটি সহজভাবে, কিছু সময়ের জন্য পানাহার না করা, অনবরত মৌলিক পুষ্টি ব্যতীত দিনের পর দিন নয়।
মার্টিন বেরধান হলেন একজন পুষ্টিবিদ এবং প্রশিক্ষক। তিনি তার প্রবন্ধে উপবাস নিয়ে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে বলেন, “না খেয়ে থাকা মানে না খেয়ে থাকা। এটা কোন একটা খাবার বাদ দিয়ে যাওয়া অথবা ২৪ ঘন্টার জন্য না খেয়ে থাকাটাকে বুঝায় না। অথবা, ৩ দিনের জন্য না খেয়ে থাকাও নয়। তাই, এই বিশ্বাস করা যে, কোন একবেলার খাবার বাদ দিয়ে দিলে অথবা সংক্ষিপ্ত সময়ের। জন্য উপবাস করলে তা ‘ক্ষুধায় মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার অবস্থায় নিয়ে যাবে; এটি পুরােপুরি হাস্যকর ও অযৌক্তিক।
- পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসে প্রতিষ্ঠাপিত হওয়ার কর্মযজ্ঞ
রামাদানের পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য অনেক মুসলিমই রামাদানের আগের মাস তথা শাবান মাসে বিক্ষিপ্তভাবে নফল রােজা রাখেন। নবীজি (ﷺ) শাবান মাসে অনেক বেশি রােজা রাখতেন। [বুখারি, হাদিস-ক্রম; ১৯৬৯; মুসলিম, হাদিস-ক্রম : ১১৫৬]
এটি রামাদানের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে অভ্যস্ত হতে সাহায্য করে। একইভাবে দিনে-রাতে কিছু নির্দিষ্ট সময় ঘুমানাের অভ্যাস থাকলে, ফজরে ঘুম থেকে উঠার এবং রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানাের নিয়মিত অভ্যাস থাকলে আপনার জন্য রামাদানের রুটিনে অভ্যস্ত হওয়া অনেক সহজ হবে। আপনি যদি অনেক বেশি চা-কফি পান করতে পছন্দ করেন তাহলে রামাদানের আগেই ধীরে ধীরে পান করার সংখ্যা কমিয়ে ফেলুন। রামাদানের অন্তত কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে এসবের পরিবর্তে লেমােনেড, হারবাল চা এবং পানি খাওয়ার অভ্যাস রপ্ত করুন।
অসময়ে নাশতা ও ফাস্টফুড খাওয়ার বাজে অভ্যাসও পরিত্যাগ করে ফেলুন। এসব খাবার আসক্তির মত। অভ্যাস আগে থেকে না বদলালে রামাদানে অসময়ে এসব খাদ্য খেতে ইচ্ছা করবে।
- ইবাদাতকে অগ্রাধিকার দিন, রান্নাকে নয়
বহু লােক রামাদানকে সর্বোত্তম খাবার তৈরীর মাস হিসেবেই দেখে। তারা ভাবে যেহেতু সারাদিন না খেয়ে থাকা হচ্ছে, তাই সন্ধ্যায় ব্যতিক্রমী কোন খাবার খেয়ে পুরস্কৃত হওয়া উচিত। অথচ, রামাদান তাে একটি বার্ষিক সুযােগ- আমাদের গুনাহসমূহকে মুছে ফেলার জন্য, আমাদের জীবনধারাকে পরিবর্তন করার জন্য এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার আরাে কাছে আসার জন্য; যাতে করে রামাদান চলে যাবার পরেও আমরা সঠিক পথে থাকতে পারি, এবং রামাদানে যেসব ভালাে কাজ ও অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম তা চালিয়ে যেতে পারি।
রামাদান বা অন্য যেকোন মাসই হােক না কেন, খাবারের ব্যাপারে আমাদের মনোেযােগ অভিন্ন থাকা উচিত। আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার জন্য সিয়াম পালন করি। তাই অতিরিক্ত সময় রান্নাঘরে ব্যয় করে নিজের নফসকে পুরস্কৃত করার কোন মানে হয় না, যখন আমাদের প্রকৃত পুরস্কার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইতােমধ্যেই লিখে ফেলেছেন।
এজন্য আমাদের প্রাথমিকভাবে আত্মিক পরিশুদ্ধির প্রয়ােজন। আমাদের খাবারদাবার বছরের আর সব দিনের মত যেন রামাদানেও একই রকম সাধারণ থাকে।
- রামাদানে হাইড্রেডেট খাবার খাওয়ার গুরুত্ব
রামাদানে ডিহাইড্রেশন বা পানিশূন্যতা রােধে এমন খাদ্য খাওয়া উচিত যা পানি ধরে রাখতে পারে। আপনি যদি খুব বেশি পানি পান করতে নিরুৎসাহিত বােধ করেন তবে আপনার জন্য হরেক রকমের মজাদার খাদ্য খেয়ে ডিহাইড্রেশন রােধ করার সুযােগ রয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে দই পছন্দ করি। এটি দীর্ঘ সময় তৃষ্ণ দূরীভূত করে। এক কাপ দইতে শতকরা পঁচাশি ভাগ পানি থাকে। এছাড়া থাকে পাকস্থলীর জন্য উপকারী ব্যাকটেরিয়া ও অনেক ক্যালসিয়াম। এছাড়া ফলের জুস, লেটুস, শসা, টমেটো, নারিকেলের পানি ও তরমুজও খুব ভালাে খাবার যা শরীরের পানি ধরে রাখতে সহায়তা করে।
- সঠিক খাবার খাওয়ার প্রয়োজনীয়তা
যদিও আমি ইফতারে খাবার খাওয়া নিয়ে অনেক মনােযােগ দিচ্ছি না, কিন্ত আমি জানি সঠিক খাবার খাওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাজ কিংবা স্কুলের জন্য রামাদানে আমাদের বেশিরভাগেরই ভিন্ন ভিন্ন কর্মপরিকল্পনা থাকে। আমাদের মধ্যে যারা সারারাত জাগতে পারেন না, তাদের যথাযথ ঘুমের সাথে যথেষ্ট খাবারও খাওয়া প্রয়ােজন, যাতে করে আমরা সিয়াম পালন করতে পারি এবং পরবর্তী দিনটি টিকে থাকতে পারি।
খাবারের রুটিন এবং অভ্যাসের পরিবর্তনের সাথে সাথে আমরা এই ব্যাপারটা ভুলেই যাই যে আমাদের ওজন বাড়তে পারে। আমাদের না আছে পরিশ্রম করার সময় আর না আমরা অর্গানিক খাদ্যের (যথাসম্ভব প্রাকৃতিক খাবার, কোনরকম রাসায়নিক বা অন্যান্য পরিবর্তন যাতে থাকে না) দিকে মনােযােগ দিই। সবচেয়ে বিস্ময়কয় ব্যাপার হচ্ছে, অনেকে ভাবেন যে ইফতার ও সাহরিতে তৈলাক্ত খাবার দিয়ে নিজের চাহিদা মেটাতে পারলেই পুরাে দিনের শক্তি পাওয়া যাবে। তৈলাক্ত খাবার আমাদের বেশি শক্তি যােগায়’- এই পুরাে ধারণাটাই ভ্রান্ত। সত্যি বলতে, এই ভারী তৈলাক্ত খাবার আপনাকে দ্রুত ক্লান্ত করে দেয়, যখন আপনি দীর্ঘ সালাতের জন্য দাঁড়ান। অর্গানিক খাদ্যের তুলনায় তৈলাক্ত, চর্বিজাতীয় খাবারের ভাঙনের হার অনেক বেশি। সুতরাং, সঠিক প্রাকৃতিক খাবার খাওয়ার প্রতি জোর দিন।
- সঠিক খাবার কোনগুলো?
রামাদানে পরিমিত ও নিয়মমাফিক খাদ্য গ্রহণের ফলে আমাদের স্বাস্থ্যের উন্নতি হওয়ার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এটা যে রামাদানে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাসের দরুন আমাদের অনেকের স্বাস্থ্যের উল্টো অবনতি ঘটে। প্রতিবছর রামাদান মাসে অতিভােজনের কারণে সৃষ্ট পাকস্থলীর সমস্যাজনিত রােগী ও ডিহাইড্রেশনের ফলে সৃষ্ট কিডনীর সমস্যাজনিত রােগীর সংখ্যা বেড়ে যায়।
রামাদানে আপনার খাদ্যতালিকা সরল ও নিয়ন্ত্রিত রাখুন। আঁশযুক্ত খাদ্য, খনিজ খাদ্য, কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাদ্য ও চর্বিহীন প্রােটিন জাতীয় খাদ্য বেশি বেশি খাওয়ার চেষ্টা করুন। সঠিক খাবারগুলাে সবসময়ই মাটি থেকে উৎপন্ন সবুজ খাবার, যা হলাে প্রাকৃতিক প্রতিষেধক এবং অধিকাংশ অসুখ-বিসুখের চিকিৎসা। রামাদানের সময় চর্বিযুক্ত, ভাজাপোেড়া এবং ‘জাংক ফুডের’ (নিম্ন পুষ্টিমান সংবলিত পূর্বপ্রস্তুতকৃত অথবা প্যাকেটজাত খাবার পরিবর্তে আপনাদের ফ্রিজ ও ভাঁড়ারঘরওলাে ফল-ফলাদি দিয়ে পূর্ণ রাখা উচিত। যেসব খাদ্য অনেক লম্বা সময় ধরে প্রস্তুত বা রান্না করতে হয়, যেসব খাবারে অনেক চর্বি থাকে বা যেসব খাবার অনেক বেশি ভেজে খেতে হয়, সেসব খাবার এড়িয়ে চলাই ভাল। কারণ এসব খাবারের কারণে বুকজ্বলা, কোষ্ঠকাঠিন্য, পানিশূন্যতা ও নিদ্রাহীনতার সমস্যা হয়ে থাকে।
- সাহরিতে কী খাবেন?
হাদিসে এসেছে, “নিশ্চয় আল্লাহ এবং তাঁর ফেরেশতাগণ যারা সাহরির খাবার খায় তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করেন।” [আল জামিউস গির, হাদিস-ক্রম: ৪৭৮৫]
সাহরির ব্যাপারে মুসলিম সমাজের মধ্যে দুইটি প্রান্তিক অবস্থা বিরাজ করছে। একদল তাে মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে ভারী ভারী সব খাদ্য ও অনেক পদের তরকারি সাজাতে শুরু করে এবং সাহরিতে রীতিমত গলা পর্যন্ত খাবার খায়। আরেকদল আছে যারা আলসেমি করে সাহরিতে তেমন কিছুই খায় না। উভয় অবস্থাই প্রান্তিক। কারণ, এ উভয় অভ্যাসের কারণেই শরীরে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যারা অতিভােজন করেন তাদের হজমে সমস্যা হয়। আর যারা একেবারেই কিছু খান না তারা দিনভর মাথাব্যথা, বিরক্তিবােধ, দুর্বলতা, অনিদ্রা ও মনােযােগহীনতায় ভুগেন।
আমাদেরকে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। রামাদানে সাহরি খাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদাত। সাহরির খাবার হওয়া উচিত স্বাস্থ্যকর ও মাঝারি পরিমাণের।
সাহরিতে আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া পাকস্থলীর জন্য উপকারী। আঁশজাতীয় খাবার আস্তে ধীরে হজম হয়, যার জন্য কোলেস্টেরল লেভেল এবং রক্তের সুগার লেভেল অনেকাংশে কমে আসে। এতে করে রােজা রেখেও আপনি দিনভর শক্তি পাবেন। আঁশজাতীয় খাবারের মধ্যে আপনি ওটস, শাকসবজি, ফল বা সিরিয়াল খেতে পারেন।
সাহরিতে কিছু প্রােটিনযুক্ত খাবার খাওয়াও উপকারী। ডিম, চবিহীন মাংস, দই, বাদাম জাতীয় খাদ্য আপনাকে দিনভর শক্তি যােগাবে।
এছাড়াও ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন জাতীয় খাবার যেমন দুধ, দই, মধু ইত্যাদি খাবেন৷ দই দিয়ে আপনি বিভিন্ন রকম পানীয় যেমন লাচ্ছি বানাতে পারেন
অথবা দুধ-কলা বা স্ট্রবেরি দিয়ে মিল্কশেকও বানাতে পারেন। খেতে যেমন মজাদার হবে, আপনার শরীরও হাইড্রেট থাকবে সারাদিন। সাহরিতে খেজুর খাওয়া সুন্নত। নবীজি (ﷺ) খেজুর ও শসা একসাথে খেতেন৷ আবদুল্লাহ ইবনু জাফর (রাঃ) বর্ণনা করেছেন, “নবীজি ৪৪ শসা খেজুরের সাথে একত্রে খেতেন।” [বুখারি, হাদিস-ক্রম: ৫৪৪৫; মুসলিম, হাদিস-ক্রম: ২০৪৩]
সাহরিতে ময়দাযুক্ত খাবার যেমন কেক, পেস্ট্রি ইত্যাদি খাবার এড়িয়ে চলুন। লবণযুক্ত খাবার যেমন আচার, সল্টেড বাদাম, সয়া সস ইতাদিও যথাসম্ভব এড়িয়ে চলুন। খাবারে লবণের পরিমাণ বেশি হলে আপনি দিনভর তৃষ্ণার্ত অনুভব করবেন। সাহরিতে চা, কফি এসব ক্যাফেইনযুক্ত খাবার মােটেই খাবেন না। কারণ, এসব খাবার সাহরিতে খেলে সারাদিন অস্থির লাগে ও পানিশূন্যতার অনুভূতি কাজ করে।
- ইফতার কী খাবেন?
হাদিসে এসেছে, “তােমাদের মধ্যে কেউ যখন রােজা রাখবে সে যেন (ইফতারে) খেজুর দ্বারা রােজা ভাঙ্গে। তা যদি না পায় তাহলে পানি দ্বারা (ইফতার শুরু করবে)। কারণ, পানি বিশুদ্ধতা দানকারী।” [ আবু দাউদ, হদিস-ক্রম : ২৩৫৫]
আমাদের প্রিয়নবী -এর সুন্নত ছিল অল্প খাবার দিয়ে ইফতার করা। আজকাল ডাক্তাররাও হালকা খাবারের দ্বারা ইফতার করার পরামর্শ দিন। ইফতার করার পর অন্তত দশ মিনিট বিরতি দিয়ে ভারী খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। দীর্ঘসময় পর একসাথে বেশি খাদ্য গ্রহণ করলে পাকস্থলীর উপর চাপ পড়তে পারে, এসিডিটি বাড়তে পারে, বমি বমি অনুভূত হতে পারে। এভাবে গােগ্রাসে গিলে ইফতারের পর মাগরিবের নামাজ পড়াও কষ্টকর হয়ে যায়। ইফতারে খেজুর, কিছু হালকা নাশতা স্বাস্থ্যকর কোন পানীয় গ্রহণ করা উত্তম হবে। এগুলাে আপনার শরীরে সুগার, খনিজ এবং পানির মাত্রা পুনরুদ্ধার করবে।
হালকা ইফতার সেরে মাগরিবের নামাজ পড়ে নিবেন। ততক্ষণে আপনার শরীর ইফতারের খাবারগুলাে হজম করে নিবে। মাগরিবের নামাজের পর আপনি চাইলে ভারী খাবার গ্রহণ করতে পারেন। আমি অবশ্য তারাবিহর পর রাতের খাবার খাওয়া পছন্দ করি। তারাবিহর আগে রাতের খাবার খেলে তারাবিহর
নামাজে আমার ঘুম ঘুম ও অবসন্ন অনুভূত হয়। রাতের খাবার কী খাবেন? রাতের খাবার হওয়া উচিত মাঝারী মানের নিয়ন্ত্রিত খাবার। ভাল হয় যদি এক পদের তরকারি দিয়েই রাতের খাবার সেরে নিন। এটি পাকস্থলীর জন্যেও উপকারী। তাছাড়া রাতের খাবারে অতিমাত্রায় না খাওয়ার কারণে সাহরির সময়ও খাওয়ার জন্য ক্ষুধা থাকবে। কুরআনে বর্ণিত স্বাস্থ্যসম্মত খাবারগুলাে এসময় খেতে পারেন। যেমন ডালিম, ডুমুর, শসা, জলপাই, খেজুর, আঙ্গুর, ইত্যাদি। এছাড়া মধু, দুধ, মাংস ইতাদিও খেতে পারেন। রামাদানের খাবারের ব্যাপারে আরাে কিছু পরামর্শঃ
- যারা পরােটা খেতে পছন্দ করেন, তারা তেল ছাড়া রুটি খাবেন
- বেশি না ভেজে হালকা ভাজা খাবার খাবেন
- গ্রীষ্মকালে মাছ-মাংস কমিয়ে খাবেন কারণ এগুলাে খেলে ঘন ঘন তৃষ্ণা জাগে
- মিষ্টান্ন হিসেবে দুধ ও দই খাবেন
- তরকারিতে লবণ ও তেলের পরিমাণ কমিয়ে মশলা, আদা, রসুন কিংবা লেবু দিয়ে স্বাদ বৃদ্ধি করবেন
- ধন্যবাদান্তেঃ--মওদুদ আহমেদ মধু @Mr Modhu (Invisible Poetry)
No comments