মানুষ নতুন কিছু কিভাবে শেখে?
মানুষ নতুন কিছু কিভাবে শেখে?
- মানুষ নতুন কিছু কিভাবে শেখে? এই নিয়ে আমার চিন্তার অন্ত নাই। আমি এখন কিছু লিখতে গেলেই ভীষণ সংকুচিত বোধ করি। নিজেকে খুব স্বল্পজ্ঞানী মনে হয়। প্রতিদিন মনে শুধু এটাই বারংবার শিখছি যে, আমি কত কম জানি। নতুন কোন কিছু শেখা তো দূরের কথা, পুরাতন জানা বিষয় গুলোই এতই যে কম জানি। এরিস্টটল এর উক্তি টা যখন মনে পড়ে, তখন তো নিজেকে জীবাণু সমতুল্য ক্ষুদ্র মনে হয়।
- এই মনে হওয়া থেকে নতুন যে আরো অনেক বিষয় শিখতে হবে তার প্রয়োজন দেখা দিল। পড়াশুনার মাত্রা দিন দিন বাড়তে লাগল। আমার মা চাচীরা আমার জন্য ভীষণ কষ্টে আছে, জিজ্ঞাসা করে যে, তোর কি এমন চাকুরী যে সারাদিন পড়াশুনার মাঝেই থাকতে হয়? এই বয়স কালের পড়াশুনা দেখে আঁড়চোখে তাঁকায় আর বলে আহারে বেচারা, ছাত্র জীবনে যদি একটু পড়াশুনার দিকে নজর দিত তাহলে আজকে এত কষ্টের চাকুরী করা লাগতনা।
- তাহলে বুঝতেই পারছেন যে ছাত্র জীবনে ফাঁকিবাজির সকল কলাকৌশল আমার রপ্ত করা ছিল এবং বই থেকে ১০০ হাত দূরে আমার অবস্থান ছিল সর্বদা। সেই আমার শুধু পাশ করে কোনমতে চাকুরীতে প্রবেশ করার মত স্বল্পজ্ঞানে এবং মূলত জীবন জীবিকার তাগিদে কিছু জিনিসপত্র শিক্ষার চেষ্টা করেই যাচ্ছি অদ্যাবধি । আমার বিনীত প্রচেষ্টার ধরণ ও পাদটীকা গুলো আপনাদের সামনে প্রকাশের দুঃসাহস করলাম।
- 🔹মানুষের মস্তিস্ক কিভাবে শেখে ?
- 🔹মানুষ প্রথম কি শিখেছিল ?
- 🔹আমাদের নতুন বিষয়ের পাঠ কিভাবে নিতে হবে।
- 🔹ছাত্রদের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের জন্য কি কি শিখতে হবে, কিভাবে শিখতে হবে।
- 🔹আমাকে ছাত্র জীবনে কেউ এই স্কিল গুলো শেখার কথা কোন শিক্ষক কিংবা অভিভাবক বললনা কেন?
- 🔹আমি এই মাঝ বয়সে এসে কোন ধরণের নতুন স্কিল শিখব, কিভাবে শিখব !
- 🔹ক্যারিয়ারে/ব্যবসায় উন্নয়ন কিভাবে শিখতে হবে।
- 🔹পুরাতন আসবাব পত্রের মত পুরাতন জ্ঞান গুলো ও যে ফেলে দিতে হয়। এই নতুন শিক্ষা কিভাবে শিখব।
- 🔹নতুন কিছু কেন এখন শিখতে হবে আবার!
- 🔹আমিতো অনেক বড় জব করি, অনেক টাকার মালিক আমার আবার শেখার বাকি কি থাকতে পারে!
- 🔹বর্তমান যুগে দুইতিন বছরের শিশুগুলো আমাদের সময়ের থেকে বেশি স্মার্ট হয়ে বেড়ে উঠছে কেন?
আমার প্রতিনিয়ত যে কাজ টা করতে হয় তা হল, গুগলে এবং ইউটিউবে ৬/৭ ঘন্টা সময় ব্যয় করা। আমি কাজে যাওয়ার আগে এক দেড় ঘন্টা, রাস্তায় দুই/তিন ঘন্টা, রাতে বাসায় ফিরে তিন/চার ঘন্টা অনবরত এই দুই মাধ্যমের যথাসাধ্য ব্যবহার নিশ্চিত করি। আর বাসায় থাকার সুযোগ যদি হয় তাহলে আমি ১০/১২ ঘন্টা সময় এই দুই মাধ্যমে ব্যয় করতে পারি।
এরপর আরেকটা কাজ করি তাহলে যে সাবজেক্ট টা নিয়ে কিছুর শিক্ষার আগ্রহ মনে জাগে, সেই বিষয়ের উপরে বেস্ট সেলার কোন বই আছে কিনা তা খুঁজতে থাকি। যদি বই পাওয়া যায় তাহলে তৎক্ষণাৎ পিডিএফ, ই-পাব কিংবা কিন্ডল ভার্শন ডাউনলোড করে ফেলি। এবং বইয়ের কাভার পেজ এর ছবিটা নীলক্ষেতে হোয়াটসএপ করে দেই, যদি কোনভাবে বইটার প্রিন্ট ভার্সন পাওয়া যায়। মোটামুটি কিন্তু বেশিরভাগ সময় পাওয়াই যায়।
এছাড়া সাধারণত গুগল থেকে সার্চ দিয়ে যে কোন বিষয়ের উপরে ১০/১২ টা আর্টিকেল কিন্তু খুব সহজভাবে পাওয়া যায়। এই আর্টিকেল গুলো একটু মনযোগ দিয়ে পড়লে দেড় দুই ঘন্টা সময় ব্যয় হয়। আর্টিকেল গুলো পড়ার সময় গুগল ডক্সে নিজের মত করে নোট নিতে থাকি। এবং পড়ার পরপরই যদি নোট টা নেয়া যায়, তাহলে মেমোরি টা খুব তাজা থাকে, তাই লিখতে ও সহজ হয়।
এরপর আরেকটা পদ্ধতি হল কানে হেডফোন লাগিয়ে ইউটিউব থেকে অডিও বই গুলো শুনে ফেলা। একটা ২৫০ পাতার বই শুনতে আপনার ৬ ঘন্টা সময় লাগবে, তার মানে তিনদিনে যদি আপনি দুই ঘন্টা করে ট্রাফিক জ্যামে বসে থাকেন অথবা চলমান অবস্থায় ও থাকেন তাহলে তৃতীয় দিনে একটা বই শেষ করতে পারবেন। যদি তিন ঘন্টা সময় দেন তাহলে তো দুই দিনেই শেষ। অডিও বুকের একটা মজার ফিচার হল, যে কথাটা ভাল লাগলো কিংবা বুঝতে একটু খট্কা লাগল, তা আবার রিওয়াইন্ড করে শোনা যায়।
আরেকটা দারুন পদ্ধতি হল, যে বিষয়ে আপনি জানতে চাইছেন ওই সংক্রান্ত বিশারদ, পন্ডিত, প্রাকটিশনারের সাথে আড্ডার ব্যবস্থা করা। এবং আড্ডার সময় না পেলে, তার সাথে আলাপটা ফোনে ও সেরে নেয়া যেতে পারে। সব চেয়ে মজাদার পদ্ধতি কিন্তু এটাই, রথ দেখাও হবে কলা বেচা ও হবে। আড্ডা যে আমাদের সবচেয়ে প্রিয় বিষয়। এবং প্রত্যেকেই কিন্তু জ্ঞানদান করতে ভীষণ গর্বিত বোধ করেন। ট্রিকস টা কিন্তু আপনার হাতে, আপনার এপ্রোচের উপরে নির্ভর করবে, ওই ভদ্রলোক আপনার জন্য তার মূল্যবান সময় নষ্ট/ব্যয় করবেন কি না! আর এই বিষয়টা রপ্ত করারও পদ্ধতি আপনাকে শিখতেই হবে।
রহস্যময় আমাদের উর্বর মস্তিস্ক।
মাথার ভেতরই মহান আল্লাহ সযত্নে রেখে দিয়েছেন মানুষের মস্তিষ্ক, যা মানবদেহের প্রধান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এখান থেকেই গোটা মানবদেহ নিয়ন্ত্রিত হয়।
- মানুষের মস্তিষ্কে আছে ১০০ বিলিয়নেরও বেশি নিউরন বা নার্ভ সেল। একটি গমের দানার সমপরিমাণ মস্তিষ্ক টিস্যুতে এক লাখের মতো নিউরন থাকে, যেগুলো পরস্পরের সঙ্গে এক বিলিয়ন বন্ধন তৈরি করে। মস্তিষ্কে প্রায় ১০ হাজার রকমের নিউরন রয়েছে। মস্তিষ্কের আদেশ এসব নিউরনের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের আকারে পৌঁছে। এসব তরঙ্গের গতি ঘণ্টায় ৪০০ কিলোমিটার বা তারও বেশি। প্রতিদিন মস্তিষ্কে ১২ থেকে ২৫ ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। লো ভোল্টেজের এলইডি জ্বালানোর জন্য যথেষ্ট। আর শরীরের যেকোনো অঙ্গের চেয়ে মস্তিষ্কে অনেক বেশি পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন হয়। আমরা শরীরের প্রয়োজনে যে খাবার খাই, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই খরচ হয় মস্তিষ্কের শক্তি উৎপাদনের পেছনে। এই খাদ্য এবং অক্সিজেন পৌঁছে দেওয়ার জন্য ১০৪০-৮০ লিটার রক্ত পরিবাহিত হয় ২৪ ঘণ্টায়।
- মস্তিষ্কের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে মহান আল্লাহ তাতে একটি পর্দা দিয়েছেন; যার নাম ব্লাড-ব্রেইন-ব্যারিয়ার। রক্ত থেকে মস্তিষ্কে কী যাবে, তা নিয়ন্ত্রণ করে এই পর্দা। ক্ষতিকর পদার্থ এই পর্দা ভেদ করে সাধারণত যেতে পারে না। তবে নিকোটিন কিংবা অ্যালকোহলকে বাধা দিতে পারে না সে। হয়তো এ কারণেই মহান আল্লাহ মদ, অ্যালকোহলসহ সব মস্তিষ্কের জন্য ক্ষতিকারক জিনিস হারাম করেছেন।
মজার কথা হলো, মস্তিষ্কে ২২ লাখ সেল আছে। মানুষ তার মাত্র ৩ শতাংশ ব্যবহার করে। খুব বেশি মেধাবীরাও ১০ থেকে ১১ শতাংশের বেশি ব্যবহার করে না।
মানবদেহের সবচেয়ে জটিল, রহস্যময় ও গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ব্রেন বা মস্তিষ্ক। মানব অস্তিত্বের সবকিছু ব্রেন দ্বারা পরিচালিত হয়। ব্রেন সম্পর্কিত জ্ঞান অর্থাৎ আত্ম-জ্ঞান এবং মানুষের মাঝে ব্যবধান হচ্ছে এক মহাসমুদ্রের। এই মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ব্রেন সম্পর্কিত পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান অর্থাৎ আত্ম-জ্ঞান লাভ করতে পারলেই মানুষ দেহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গকে ব্যবহার করতে পারবে পরিপূর্ণভাবে। এখনকার অনেক সীমাবদ্ধতা ও মনোদৈহিক অসুবিধাকে অতিক্রম করতে পারবে। নিজের জন্যে সৃষ্টি করতে পারবে সাফল্য ও সম্ভাবনার নতুন মাত্রা।
প্রাণের সর্বশ্রেষ্ঠ বিকাশ মানুষ নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে ব্রেনের কারণেই। হার্টকে বলা যেতে পারে একটা পাম্পমেশিন। ফুসফুসকে বলা যেতে পারে অক্সিজেন সমদ্ধকরণ যন্ত্র। কিন্তু মানুষের প্রতিটি কাজের পেছনে নিয়ন্ত্রক শক্তি হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল চিন্তা ও সচেতনতার কেন্দ্র হচ্ছে ব্রেন। মানুষের সকল উদ্ভাবনী দক্ষতার উৎস হচ্ছে ব্রেন।
ব্রেনের এই দক্ষতার কারণে মানব জাতির পূর্বপুরুষের দৈহিকভাবে তারচেয়ে বহুগুণ শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাভূত করে শুধু টিকেই থাকেনি, বরং প্রাণীকূলের মাঝে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছে। ব্রেনই মানুষকে প্রথম পাথরের অস্ত্র তৈরি করতে শিখিয়েছে। আর সেই ব্রেনের জেনেটিক উত্তরসূরীরাই বানিয়েছে মহাশূন্য যান। মানুষ অতীতে যা করেছে, ভবিষ্যতে যা করবে তা এই ব্রেনের ফসল। ব্রেনই মানুষকে মানুষ বানিয়েছে।
মানব জাতি ব্রেন সম্পর্কে পুরোদমে গবেষণা শুরু করেছে ৬০-এর দশক থেকে। ব্রেনের কার্যক্রম বোঝার ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এই আগ্রহের কারণ হচ্ছে, ব্রেনের ভেতরে যা ঘটছে তা থেকে ব্রেনের বাইরে যা ঘটছে তাকে আলাদা করা যায় না। তাই প্রতিবিছরই বেশি সংখ্যক বিজ্ঞানী ব্রেনের কার্যকম নিয়ে গবেষণায় জড়িয়ে পড়ছেন। যত জানছেন, তত বেশি করে তাদের সামনে ধরা পড়ছে এ জানার সীমাবদ্ধতা। মানুষ পরমাণুকে চূর্ণ করেছে, জেনেটিক কোডকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছে। চাঁদে পা রাখতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এখনও স্মৃতি, শিক্ষা, সচেতনতার রহস্য রহস্যই রয়ে গেছে। তাই এখনও সে নিজেকে বুঝতে পারেনি। বিশিষ্ট বিজ্ঞান ড. ফ্রান্সিস অটো স্মীথ তাই বলেছেন, ‘মানুষকে বুঝতে হলে প্রথম ব্রেনকে বুঝতে হবে।
- কম্পিউটারের সঙ্গে এর তুলনা করা হলেও একটি আধুনিক কম্পিউটার ১০০ বিলিয়ন ‘বিট’ তথ্য জমা ও মনে করতে পারে, সেখানে ব্রেনের সামর্থ্য অসীম। কম্পিউটার অবশ্য ব্রেনের চেয়ে দ্রুত বেতন তালিকা, হিসেব তালিকা, মহাশূন্য যানের গতিপথ নির্ণয় করতে পারে। কিন্তু কম্পিউটার শুধুমাত্র সে কাজগুলোই করতে পারে যা তার নির্মাতা মানুষ তাকে করার জন্যে প্রোগ্রাম করেছে।
- অপরদিকে ব্রেন অনেক অনেক সূক্ষ্ম কাজ অনায়াসে সম্পন্ন করে। মানুষের হার্ট ও দম মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেন, গরম কিছুতে ছ্যাকা লাগার সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নেয় ব্রেন। আর এ নিয়ন্ত্রণ পরিচালিত হচ্ছে মানুষের সচেতনতার অজ্ঞাতে। এছাড়া ব্রেন নিজেকে নিজে মেরামত করতে পারে। ব্রেন নষ্ট হলে কোন কোন ক্ষেত্রে ব্রেনের কোন কোন অংশ অপর অংশের কাজ রপ্ত করতে ও পরিচালিত করতে শিখতে পারে, যা কম্পিউটার পারে না। কম্পিউটারকে সুইচ অফ করে বন্ধ করে দেয়া যায়, কিন্তু ব্রেনকে বন্ধ করার উপায় নেই। আপনি কাজ করুন বা ঘুমিয়ে থাকুন ব্রেন সব সময়ই সক্রিয় থাকে।
বিশ্বের একটি সুপার কম্পিউটার হচ্ছে ক্রে-১ কম্পিউটার। মিলিয়ন ক্যালকুলেশন করতে পারে। মস্তিষ্ক পারে ২০ হাজার বিলিয়ন। ক্রে-১ কম্পিউটার প্রতি সেকেন্ডে ৪০০ মিলিয়ন ক্যালকুলেশন হিসেবে একশত বছর কাজ করলে মস্তিষ্কের মাত্র ১ মিনিটের কার্যক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে। ব্রেনের নিউরোনের যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাকে তুলনা করলে মস্তিষ্কের সামনে এটির তুলনামূলক অবস্থান হবে একটি চীনা বাদামের সমান। দীর্ঘ গবেষণার পর বিজ্ঞানীরা মাত্র বুঝতে শুরু করেছেন যে, মস্তিষ্ক হচ্ছে এক বিস্ময়কর জৈব কম্পিউটার। যার অসীম সম্ভাবনা এখনও প্রায় পুরোটাই অব্যবহৃত রয়ে গেছে।
ব্রেন সেলগুলো যে বৈদ্যুতিক ও রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় কত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় এবং একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্যে যে কত সংখ্যক নিউরোন সেলের পারস্পরিক যোগাযোগ প্রয়োজন হয় তা কল্পনা করতে গেলেও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয়। জার্মানীর বিখ্যাত ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের পরিচালক ড. ম্যানফ্রেড ইগান নিরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ব্রেনের কোন কোন কেমিক্যাল রি-অ্যাকশন সংগঠিত হতে সময় লাগে মাত্র এক সেকেন্ডের ১০ লাখ ভাগের এক ভাগ সময়। তিনি বলেছেন, একটি দ্রুতগামী গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচার জন্যে এক পা পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়া ও তা কার্যকরী করার জন্যে ১ লাখ নিউরোনের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন হয় এবং পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয় এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে।
জীবন ধারণের জন্যে অত্যাবশ্যক প্রাণ-রাসায়নিক প্রক্রিয়া চালু রাখার পুরো কাজই করে ব্রেন। এ প্রক্রিয়া যেমন জটিল তেমনি একটির সঙ্গে অন্যটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং নির্ভরশীল। এর যে কোন পর্যায়ে সমন্বয়ের বিন্দুমাত্র বিচ্যুতি পুরো প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করে দিতে পারে। যেমন রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া না থাকলে খাদ্য হজম এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগ্রহ করে দেহের সর্বত্র প্রেরণ করতে পারতেন না। আবার আপনি যদি খাবার শনাক্ত করতে ব্যর্থ হতেন অথবা শনাক্ত করতে পারলেও যদি সঠিকভাবে হাত ব্যবহার করে তা ধরে ঠিকমত দুই ঠোঁটের মাঝখানে মুখে প্রবেশ করাতে না পারতেন তাহলে আপনার হজম প্রক্রিয়াও কোন কাজে আসত না। কিন্তু আপনি কোন রকম চিন্তা না করেই অবলীলায় সামনের খাবার তুলে মুখে দিয়ে চিবানোর সঙ্গে সঙ্গে মুখের গ্রন্থিগুলো লালা নিঃসরণ শুরু করে দেয় আর আপনি কোন সচেতন প্রচেষ্টা ছাড়া তা গলাধঃকরণ করে পাকস্থলীতে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।
এনজাইম তৈরি হয়ে শুরু হচ্ছে পাকস্থলীর খাবার হজমের প্রক্রিয়া। হজম প্রক্রিয়ায় শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সংগৃহীত হচ্ছে আর রেচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অপ্রয়োজনীয় অংশ শরীর থেকে নির্গত হচ্ছে। ব্রেন দেহের এই পুরো প্রক্রিয়াকে এমনভাবে পরিচালিত করে যাতে করে প্রতিটি কাজ ঠিক সময়ে শুরু হয় এবং ঠিক সময়ে শেষ হয়। একে একটা সুসমন্বিত রিলে রেসের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। যদি প্রতিটি প্রক্রিয়ার মধ্যে সমন্বয়ের কোন অভাব হত, তাহলে দেখা যেত মুখে খাবার প্রবেশ করার পরও লালা নিঃসরণ হচ্ছে না অথবা খাবার হজম না হয়েই পাকস্থলী, অন্ত্র পার হয়ে রেচন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যাচ্ছে।
আমরা আগেই দেখেছি ব্রেন এই কাজগুলো সুচারু রূপে করতে পারছে, দেহের অভ্যন্তরে প্রতিটি অংশের সঙ্গে সংযোগ এবং বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার ফলে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় কখনও কখনও ৬ষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্রেন পায় বাইরের তথ্য আর ভেতরের তথ্য সংগৃহীত হয় রিসিপটরের মাধ্যমে। তথ্য পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ কার্যকরী করার জন্যেও ব্রেন ও শরীরের নির্দিষ্ট অঙ্গের রয়েছে সংযোগ। ব্রেন এই তথ্য সংগ্রহ ও কর্ম নির্দেশনা প্রদান করে দুই পদ্ধতিতে। প্রথমত অতিদ্রুত পদ্ধতি নার্ভাস সিস্টেমের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত ইন্ডোক্রাইন সিস্টেমের মাধ্যমে (হরমোন দ্বারা) শ্লথ গতিতে।
ব্রেন কোন হুমকি দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেহকে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হওয়ার জন্যে কেমিক্যাল ম্যাসেঞ্জার পাঠাচ্ছে। এই কেমিক্যাল ম্যাসেঞ্জার আবার ব্রেনকে আরও সতর্ক করার কারণ হতে পারে। পরিণামে ব্রেন মূল বিপদ কেটে যাওয়ার পরও সতর্ক সঙ্কেত পাঠানো অব্যাহত রাখতে পারে। এই ফিডব্যাক লুপকে কোন না কোনভাবে সংশোধন করতে না পারলে দেহে ক্ষতিকর টেনশন সৃষ্টি করে, যা দেহের জন্যে যেমন ক্ষতিকর, তেমনি ব্রেনের সার্কিটও জ্যাম করে দেয়।
অনুশীলনে দক্ষতা বৃদ্ধিতে মস্তিষ্কের ভূমিকা টা কি?
ক্লাস ফাইভে পড়া কালীন সময়ে তারাবীর নামাজ পড়তে গিয়ে আমি প্রথম এই অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। একজন হাফেজ সাহেব সুললিত কণ্ঠে ৩০ পারা কোরআন কেন মুখস্থ করে ফেলতে পারছেন। আবার বাজার জামে মসজিদেও আর এক হুজুর নামাজ পড়াচ্ছেন উনিও একইভাবে এত্ত মোটা কোরআন শরীফ মুখস্থ পড়ছেন। পরের দিন ইফতারী দিয়ে আসার সময় দেখলাম হুজুর ভীষণ দ্রুততার সাথে দুলে দুলে চোখ বন্ধ করে কোরআন পড়ছেন। প্রতিদিন দেখতাম সারাদিন জুড়ে উনি শুধুই চর্চাই করেন যেন নির্ভুলভাবে একটা পারা যেন পড়তে পারেন। এটাই আমার কাছে প্রথম প্রমান, কোনো কিছুতে পারদর্শী হওয়ার পেছনে অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। এটি এক প্রকার অলিখিত নিয়মই বলা যেতে পারে। আমরা যখন নতুন কিছু শিখতে যাই, তখন শুরুতে আমাদের অনেক মনোযোগ দিতে হয়। এরপর ধীরে ধীরে বস্তুটি আয়ত্তে চলে আসলে আর আগের মতো মনোযোগ দেওয়ার দরকার হয় না।
হাইস্কুলে পড়ার সময় আর এক বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। আমাদের স্কুল টিমের ফুটবল প্রশিক্ষক (মন্টু কোচ) এলেন জেলা শহর থেকে। কিন্তু লোকটাকে ভীষণ বিরক্তিকর লাগলো, কারণ হল খেলার চেয়ে নানা প্রকার কসরত চর্চাতে আর জ্ঞান প্রদর্শনে তার মনোযোগ যেন একটু বেশি। দেড় ঘন্টার মত নানা প্রকার কার্যক্রম পরিচালনা করেন। বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন। ব্ল্যাকবোর্ডে কি যেন আঁকাআঁকি করে শেখানোর চেষ্টা করেন। মাইন্ডসেট বিষয় টা যে মূল ফোকাস ধরে রাখার ক্ষেত্রে এই সব বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা করেন। টিম বিল্ডিং, নেতৃত্ব, লক্ষ্য স্থির, সাব-কনশাস মাইন্ডের পাওয়ার কি সব আবোল তাবোল কথা বলতেন শুধু। আর শেষে আধা ঘন্টা আমাদের দুই দলে ভাগ করে একটু খেলতে দেন। আমি বিরক্ত হয়ে স্পোর্টস টিচারের কাছে কমপ্লেইন করলাম, স্যার তখন বিষয়টা বুঝিয়ে দিলেন যে, ঐ আধা ঘন্টা খেলার চেয়ে অনুশীলন পদ্ধতি, পদ্ধতি গুলোর প্রয়োগ, সঠিক সময়ে সঠিক পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করা, পুরাতন ভুল গুলোকে চিহ্নিত করে তা দমন করা, বারবার অনুশীলনের মাধ্যমে নতুন ব্যাপারগুলোকে অভ্যস্ততায় পরিণত করা। এবং সকল কিছুর সাথে মস্তিষ্কের সংযোগ ঘটানোর যে কি পরিমান উপকার সেটা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলেন। আমরা সকলেই মোটিভেটেড হয়ে গেলাম। প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেলাম।
আমরা জেলার চ্যাম্পিয়ন দল ছিলাম, কিন্তু দুই তিন মাস প্রশিক্ষণের পরে সব গুলো খেলাতে একের পর এক হারতে লাগলাম। মনোবল ভেঙে গেল। মন্টু কোঁচের উপরে তো সকলেই সেই গরম। কিন্তু হেড মাস্টার সাহেব মৃদু হাঁসেন আর বলেন প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে। মন্টু কোঁচের ও দেখি কোন বিকার নাই। প্রত্যেকটা ম্যাচে উনি কি যেন খালি লিখে রাখতেন। আমাদের তো মেজাজ বিগড়ে যেত। হেরে যাওয়া পরে উনি প্রত্যেকটা খেলার ভুলভ্রান্তির একটা তালিকা পেশ করলেন। প্রত্যেকটার জন্য একটা করে বিশ্লেষণ দাঁড় করালেন এবং আমাদের উপর দ্বিগুন জ্ঞান প্রদর্শন করতে থাকলেন। ৬ মাস পরে আমরা জয়ের মুখ দেখলাম।
আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে ঠিক এই দশাতেই আমরা পড়ে আছি। পুরাতন পদ্ধতিতে চ্যাম্পিয়ান হয়েছিলাম, রপ্তানী ট্রফি তো বারবার জিতছি তাই নতুন কিছু মস্তিষ্কে ধারণ করতে আমাদের বড্ড অনীহা।
আমাদের মস্তিষ্ক দুই ধরনের পদার্থ দিয়ে তৈরি। এগুলোকে বলা হয় গ্রে ম্যাটার ও হোয়াইট ম্যাটার। দুটি পদার্থের ভিন্ন ভিন্ন কাজ রয়েছে। আমাদের পেশী চালনা, সিদ্ধান্ত নেওয়া, দেখা, কথা বলা ও শোনার অনুভূতি, আবেগ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রিত হয় মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার সমৃদ্ধ অংশগুলো থেকে। আর হোয়াইট ম্যাটারের কাজ হলো এই সকল গ্রে ম্যাটার সংলগ্ন অংশগুলোর মাঝে যোগাযোগ তৈরি করা। মূলত নিউরনের কোষদেহ গ্রে ম্যাটার ও অ্যাক্সন হোয়াইট ম্যাটারে পরিপূর্ণ থাকে। আমরা বারংবার যেই ‘তথ্য’ আদান-প্রদানের কথা বলছি, এই তথ্য বলতে আসলে বৈদ্যুতিক সংকেতকে বোঝায়। আমাদের মস্তিষ্কে সকল কাজ এই সংকেতের আদান-প্রদানের মাধ্যমেই হয়ে থাকে।
এখন আমরা অ্যাক্সনকে একটি বৈদ্যুতিক তারের সাথে তুলনা করতে পারি। বৈদ্যুতিক তারের পরিবাহী অংশে প্লাস্টিক বা অন্য অপরিবাহী পদার্থের প্রলেপ দেওয়া হয়। এই প্রলেপ বা ইনসুলেশনের মূল উদ্দেশ্য হলো বিদ্যুৎ সরবরাহ যেন সঠিকভাবে হয় এবং তারের মধ্যে যাতে বৈদ্যুতিক গোলযোগ না থাকে। অনুশীলনের ক্ষেত্রেও আমাদের নিউরনগুলোর অ্যাক্সনে ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটে। আর এক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ভাবে অ্যাক্সনে এক প্রকার প্রলেপ তৈরি হয়। যেই পদার্থ দিয়ে এই প্রলেপ তৈরি হয়, তার নাম হলো মায়েলিন। আর এই প্রক্রিয়াকে বলে মায়েলিনেশন।
আমরা যখন অনুশীলনের মাধ্যমে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করি, তখন আমাদের নিউরনের অ্যাক্সনগুলোতে মায়েলিনের নতুন স্তর তৈরি হতে থাকে। কাজেই মায়েলিনের স্তর যত বৃদ্ধি পায়, নির্দিষ্ট কিছু নিউরনের মাঝে সংকেত পরিবহণের গতিও বাড়তে থাকে। ঠিক এই কারণেই প্রথমবারের মতো কিছু শেখার সময় আমাদের সময় বেশি লাগে। অর্থাৎ মায়েলিনের নতুন স্তর তৈরি হতে থাকে। আর ধীরে ধীরে চর্চা চালিয়ে গেলে আমাদের গতিও বেড়ে যায়। কাজেই যারা নিজেদের কাজে অনেক দক্ষ, তাদের এই দক্ষতার পেছনে মূল কারণ হলো, তারা অনুশীলন করেছে। আর অনুশীলনের কারণে তাদের মস্তিষ্ক ঐ নির্দিষ্ট কাজটি দ্রুত ও সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে পারে।
এখন কথা এখানেই শেষ নয়। মায়েলিনেশনের এই প্রক্রিয়া একটি নবজাতকের গর্ভে থাকা অবস্থাতেই প্রাকৃতিক ভাবে শুরু হয়। ছোট বাচ্চাদের মস্তিষ্কে মায়েলিনেশন সবচেয়ে দ্রুত হয়। আর বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর হার কমতে শুরু করে। তবে এটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় না। গ্লিয়া কোষ নামে মস্তিষ্কে এক বিশেষ ধরণের কোষ ঠিকই এই মায়েলিনের প্রলেপ তৈরি করতে থাকে। বিজ্ঞানীরা বলে থাকেন যে, ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশ ঘটে। তবে কথাটি সব ক্ষেত্রে সত্যি নয়।
এই মায়েলিন নামক বস্তুটি মূলত হোয়াইট ম্যাটার দিয়ে তৈরি। কাজেই যেসব দক্ষ ক্রীড়াবিদ, গায়ক, কম্পিউটার প্রোগ্রামাররা নিয়মিত চর্চা করেন, তাদের মস্তিষ্কে হোয়াইট ম্যাটারের তারতম্য হওয়ার কথা। গবেষকরা তাই ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিংয়ের সাহায্য নিয়ে একটি গবেষণা চালান। এই গবেষণাটিতে তারা ক্রীড়াবিদ ও সাধারণ মানুষদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখেন। এখানে দেখা যায় যে, ক্রীড়াবিদ ও সংগীতজ্ঞদের মস্তিষ্কের কিছু কিছু অংশে হোয়াইট ম্যাটারের আধিক্য বেশি। মস্তিষ্কের এই অংশগুলো তাদের সংশ্লিষ্ট কাজের সাথেই সম্পর্কিত। অর্থাৎ নিয়মিত প্রশিক্ষণের কারণে তাদের মস্তিষ্কের প্রয়োজনীয় জায়গাগুলোতে মায়েলিনেশন ঘটেছে।
পরিমিত ঘুম অনেক জরুরী। এখানে হুট করে ঘুমের কথা এজন্য বলা হচ্ছে, কারণ মায়েলিনেশনের প্রক্রিয়াটি আমাদের ঘুমের মাঝেই ঘটে। কাজেই একজন ছাত্র যতই পড়াশোনা করুক, একজন ক্রীড়াবিদ যতই প্রশিক্ষণে সময় দিক না কেন, ঠিকমতো না ঘুমালে তার প্রভাব শরীরে পড়বে না। শেখার কাজটা বলতে পারেন, তার দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সংযোগ সৃষ্টি করার মতো। একাধারে অনেকক্ষণ অনুশীলন করলে আমরা কাজটা আয়ত্তে আনতে পারি ঠিকই। কিন্তু মস্তিষ্কে একরকম তারের জঞ্জালের মতো অবস্থা তৈরি হয়। ঘুমের মধ্যে মস্তিষ্ক নিজে নিজে এই জট খুলে সব তথ্য সুন্দরভাবে গুছিয়ে রাখে। কোনো কিছু শেখার সময় মূলত অ্যাক্সন থেকে অন্য নিউরনের কোষদেহে বৈদ্যুতিক চার্জ পরিবাহিত হয়। তবে ঘুমানোর সময় ঠিক উল্টো দিকে এই পরিবহণ ঘটে। এতে করে কোষগুলোর মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্থা আরো দ্রুত ও মজবুত হয়।
অনেকে অভিযোগ করতে পারেন, “আমরা তো অনেক পরিশ্রম করি, কিন্তু উন্নতি তো তেমন হয় না”। এই প্রশ্নের উত্তর আসলে অনেক সহজ। আমাদের প্রত্যেকের মস্তিষ্কই ভিন্নভাবে কাজ করে। এখানে জেনেটিক বা বংশগত ব্যাপারটা যেমন দায়ী, তেমনি শেখার পরিবেশেরও একটা প্রভাব রয়েছে। কোনো নতুন কৌশল রপ্ত করার সময় আমরা যদি একই পদ্ধতি বারংবার প্রয়োগ করি, তবে এক জায়গায় এসে মায়েলিনেশন থেমে যায়। অর্থাৎ আমাদের উন্নয়ন একটা জায়গায় এসে থমকে দাঁড়ায়। এ কারণে অবশ্যই কিছু নতুনত্ব প্রয়োগ করা জরুরী।
নির্দিষ্ট একটা কাজে অন্য সবার থেকে ভালো হওয়ার সমীকরণটা আসলে অনেক সহজ। আমরা যে কাজে যত বেশি সময় দিব, তাতে আমরা তত ভালো করব। যেই ছাত্র অন্যদের তুলনায় বেশি পড়াশোনা করে, তার পরীক্ষার ফলাফল এ কারণে ভালো হয়। যেই প্রোগ্রামার দিন-রাত নিত্যনতুন প্রোগ্রামিং সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে, সে তত ভালো প্রোগ্রামার হয়। একজন মানুষের পেশাগত দক্ষতাও নির্ভর করে সে কাজটিতে কতটুকু মনোযোগ ও সময় দিচ্ছে তার উপর। এই সকল কাজের কাজি হলো আমাদের মাথার উপরে দেড় কেজি ওজনের বস্তুটি। এই রহস্যময় অঙ্গটি প্রতিনিয়ত নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় রত থাকে।
আমাদের মস্তিষ্কের প্রধান উপাদান হলো স্নায়ুকোষ বা নিউরন। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের সকল স্মৃতির ধারক ও বাহক হলো এই নিউরন। নিউরনের রয়েছে তিনটি অংশ। এগুলো হলো: কোষদেহ, অ্যাক্সন ও ডেনড্রাইট। নিউরনকে একটি স্কুল হিসেবে বিবেচনা করলে কোষদেহ হলো সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। অন্যান্য উপাদানগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে কিনা তার দেখাশোনা করে এই কোষদেহ। অ্যাক্সন হলো তারের মতো লম্বা বস্তু যা কোষদেহ থেকে বের হয়। এটির কাজ হলো একটি নিউরন থেকে অন্য নিউরনে তথ্য পাঠানো। আর ডেনড্রাইট হলো কোষদেহ থেকে বের হওয়া ছোট ছোট প্রবৃদ্ধি। একটি নিউরনের ডেনড্রাইট অন্য একটি নিউরনের অ্যাক্সনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। এই সংযোগস্থলের নাম হলো সিন্যাপ্স। এখানে অ্যাক্সন তার নিজ নিউরন থেকে যে তথ্য পাঠায় তা অন্য নিউরনের ডেনড্রাইট গ্রহণ করে। এভাবে আমাদের মস্তিষ্কে কয়েক বিলিয়ন নিউরন একে অপরের সাথে যুক্ত।
আমাদের মস্তিষ্ক থেকে স্পাইনাল কর্ডের মাধ্যমে সারা শরীরে স্নায়ু টিস্যু বা নার্ভ টিস্যু ছড়িয়ে রয়েছে। আমাদের যখন কোনো মশা কামড় দেয়, তখন কোনো রকম চিন্তা ছাড়াই আমাদের হাত সরাসরি মশাটি মারার জন্য উদ্যত হয়। এখানে আসলে যা ঘটে তা হলো, প্রথমে আমাদের শরীরে যে অঙ্গে মশাটি কামড় দিয়েছে, সেখান থেকে ব্যথা পাওয়ার অনুভূতি মস্তিষ্ক গ্রহণ করে। এরপর এটি নিউরনের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে সরাসরি হাতে সেই মশার অবস্থান সম্পর্কে তথ্য দেয়। তারপর হাত সেই নির্দিষ্ট অঙ্গে থাবা বসিয়ে মশাটি মেরে ফেলে। এখানে পুরো ব্যাপারটা অনেক দ্রুত হয় বলে আমাদের চিন্তা করার প্রয়োজন পড়ে না।
মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় সারাজীবনই নতুন কোষ তৈরি হয়। কমপক্ষে ৯৭ বছর পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া চলে বলেই ধারনা করা হচ্ছে।
এতদিন মনে করা হতো যে, জন্মের সময় মস্তিষ্কে যে পরিমাণ কোষ থাকবে জীবনভর সে সংখ্যাটিই রয়ে যাবে, তাই নতুন ধারনাটি ব্যাপকভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করবে। ইউনিভার্সিটি মাদ্রিদের একদল গবেষক এমনও দেখিয়েছেন যে, বয়সের সাথে সাথে নতুন কোষ তৈরির সংখ্যাও বন্ধ হয়ে গেছে।
এবং আলঝেইমার রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে কোষের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমতে থাকে-তাই ডিমনেশিয়া বা স্মৃতিভ্রংশ রোগের জন্যে এমন গবেষণা নতুন ধারনার সৃষ্টি করে। আমাদের মস্তিষ্কের বেশিরভাগ কোষ যা নিউরন নামে পরিচিত নিজেদের মধ্যে বৈদ্যুতিক সংকেত পাঠায়- আর এই প্রক্রিয়া আমাদের জন্মের সময় থেকেই শুরু হয়।
অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে গবেষণায় দেখা গেছে, জীবনের পরবর্তী সময়েও তাদের মস্তিষ্কে নতুন কোষের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মানুষের ক্ষেত্রে নতুন নিউরনের উদ্ভব বা যে প্রক্রিয়াকে বলা হয় 'নিউরোজেনেসিস'- অব্যাহত থাকে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থেকে গেছে। 'নেচার মেডিসিন' সাময়িকীতে প্রকাশিত এই গবেষণাটি করা হয় ৫৮ জন মৃত মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ে। যাদের বয়স সীমা ছিল ৪৩ থেকে ৯৭।
মূল মনোযোগ দেয়া হয় ব্রেন বা মস্তিষ্কের 'হিপ্পোক্যাম্পাস' নামক অংশ- যেটি স্মৃতি এবং আবেগ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখে। যেমন আপনি আপনার গাড়িটি কোথায় পার্ক করে এসেছেন সেটি মনে করতে মস্তিষ্কের এই অংশটি ব্যবহৃত হয়। গবেষকরা মস্তিষ্কে এই অপরিণত বা 'নতুন' নিউরনকে নির্দিষ্ট করতে পেরেছেন।
একটি সুস্থ মস্তিষ্কে বয়সের সাথে সাথে নিউরোজেনেসিস বা নিউরনের বৃদ্ধির পরিমাণ 'সামান্য কম' দেখতে পাওয়া যায়। গবেষক ড. মারিয়া লরেন্স-মার্টিন বলেন, "আমার বিশ্বাস, মানুষ যতক্ষণ নতুন কিছু শিখছে ততক্ষণ নতুনভাবে নিউরনের বৃদ্ধি ঘটছে। এবং এটি আমাদের জীবনের প্রতি মুহূর্তেই ঘটে চলেছে।"
কিন্তু আলঝেইমার রোগীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি ভিন্ন। আলঝেইমারের প্রাথমিক পর্যায়ে নতুন নিউরন বৃদ্ধির সংখ্যা প্রতি মিলিমিটারে ৩০,০০০ থেকে কমে দাড়ায় ২০,০০০ এ। ড. লরেন্স-মার্টিন এর মতে, "রোগটির একদম শুরুতে এই হ্রাসের পরিমাণ থাকে ৩০%।"
আলঝেইমার রোগটি এখনো নিরাময়যোগ্য নয়। যদিও এই পদ্ধতি ব্যবহার করে এমন অনেক গবেষণা ব্যর্থ হয়েছে এবং সর্বশেষ গবেষণায় দেখা গেছে যে রোগটির শুরুর দিকে আরো বিশেষ কিছু ঘটছে।
ড. লরেন্স-মার্টিন বলছেন যে কেন নিউরোজেনেসিস প্রক্রিয়া হ্রাস পায় সেটি বুঝতে পারলে তার জ্ঞান কাজে লাগানো যাবে আলঝেইমার এবং স্বাভাবিক বয়স জনিত রোগের ক্ষেত্রে। কিন্তু তিনি মনে করেন যে, এই গবেষণার পরবর্তী ধাপে গিয়ে হয়তো জীবিত মানুষের মস্তিষ্ক পর্যবেক্ষণের প্রয়োজন পরবে। সময়ের সাথে সাথে সেখানে কি ঘটে তা দেখার জন্যে।
আলঝেইমার রিসার্চ ইউকে গবেষণার প্রধান ড. রোসা সানচো বলেন, "যদি কখনো আমরা জীবনের শুরুর দিকে স্নায়ু কোষ হারাতে শুরু করি, সেক্ষেত্রে এই গবেষণা দেখাচ্ছে যে, পরবর্তীতে নতুন কোষের সৃষ্টি হতে থাকবে, এমনকি ৯০ বছর পর্যন্ত।" তবে এই নিয়ে আরো বড় পরিসরে গবেষণার তাগিদ দেন তিনি।
লিখেছেনঃ— Habibur Rahman
Smart Factory 4.0 Consultant for Textile Apparel Industries.
ধন্যবাদান্তেঃ---"মিঃ মধু"
আরও বিস্তারিত জানতে চেক করুন "অদৃশ্য কাব্য" মঞ্চ।
No comments