হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস "অচিনপুর" পঞ্চম-পর্ব । @মিঃ মধু
---অচিনপুর---
(পঞ্চম-পর্ব)
টিনের কানেস্তারায় বাড়ি পড়েছে। উচ্চকণ্ঠে কি যেন ঘোষণা করা হচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে দাঁড়াতেই দেখি, বাদশা মামা বিব্রত মুখে সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে হাঁটছেন। তার আগে আরেকজন টিনে বাড়ি দিয়ে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে কি বলছে। আমি বললাম, কি ব্যাপার মামা?
কিছু না, কিছু না।
ঢোল দিচ্ছে কে? আপনি নাকি?
হুঁ।
কিসের জন্যে?
বাদশা মামা দাঁড়িয়ে পড়লেন। জড়িত কণ্ঠে বললেন, রহমত পাগলের জন্যে ঢোল দিচ্ছি, যদি কেউ পায় তাহলে পাঁচ টাকা পুরস্কার।
কেন, কি হয়েছে?
বাদশা মামা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি ততক্ষণে তার হাত চেপে ধরেছি। মামা অসহায়ভাবে তাকালেন আমার দিকে। আমি দৃষ্ট গলায় বললাম, বলেন কি ব্যাপার।
রঞ্জু, পাগলটাকে খেদিয়ে দেবার পর থেকে যত অশান্তি শুরু হয়েছে। ফিরিয়ে আনলে যদি সব মিটে।
মামা আমার হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। বাদশা মামা আরো অনেক রকম পাগলামি করতে লাগলেন। নানাজানের একটি আম-কাঁঠালের প্রকাণ্ড বাগান ছিল। জলের দরে সেটি বেঁচে দিলেন। বিক্রির টাকা দিয়ে নাকি মসজিদ করবেন। ছোট নানীজান কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, এসব কী রে বাদশা?
বাদশা মামা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন, তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেন সাদা পোশাক পরা এক জ্যোতির্ময় পুরুষ তাকে বললেন, মসজিদ কর, সব ঠিক হবে। ছোট নানীজান বললেন, বাদশা, তুই মিথ্যা কথা বলছিস। বাদশা মামা মাথা নিচু করে চলে গেলেন। মসজিদের জন্য ইট পুড়ানো হতে লাগল। ময়মনসিংহ থেকে রাজমিস্ত্রি আসল। বিরাট মিলাদ মহফিলের মধ্যে মসজিদের কাজ শুরু হল।
নানাজানের দুটি বিল ছিল। বিলের মাছ থেকে পয়সা আসত বিস্তর। সেই টাকায় সংসার খরচ গিয়েও বেশ মোটা অংশ জমত। বিল দুটি একইসঙ্গে হাতছাড়া হয়ে গেল। কী ভাবে হল কেউ বলতে পারল না। নানীজান সারাদিন চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
রহিম শেখ একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলা রুজু করল। সমস্তই মিথ্যা মামলা। বাদশা মামা নির্বিকার বসে আছেন মসজিদের সামনে। দেখছেন কী করে ইটের পর ইট বিছিয়ে ভিত তৈরি হচ্ছে। মামলার তদবীরের জন্য ছোট নানীজানকে নিয়ে আমিই যাওয়া-আসা করতে লাগলাম। দীর্ঘদিন মামলা চলল। দুটিতে জিত হল আমাদের, একটি রহিম শেখ পেল।
নানাজান হজ থেকে ফিরে এলেন এই সময়ে। সংসারের তখন ভরাডুবি ঘটেছে। রোজকার বাজারের টাকাতেও টানাটানি পড়তে শুরু করেছে। নানাজান কিছুই বলল না। ছয় মাসেই তার বয়স ছবছর বেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে নিম্প্রভ, একা একা হাঁটতে পারেন না। লাঠিতে ভর না দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। চোখের সামনে সংসারকে ভেঙে পড়তে দেখলেন। তবু সকালেবেলায় কোরাওন শরীফ ধরে বিলম্বিত সুরে পড়তে লাগলেন। “ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।” অতএব তুমি আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করিবে?
বৎসর যাবার আগেই সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিতে হল। বাদশা মামার মসজিদ ততদিনে শেষ হয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে চমৎকার নকশি কাটা গম্বুজ। ধবধব সাদা দেয়ালে নীল হরফে লেখা কলমায়ে তৈয়ব। পাড়ার ছেলেমেয়েরা আমপারা হাতে সকালবেলাতেই মসজিদে ছবক নিতে আসে। দেখে-শুনে বাদশা মামা মহাখুশি। মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে মসজিদের সামনে পুকুর কাটিয়ে দিলেন। কি সুন্দর টলটলে জল, পুকুরে পাথরে বাঁধানো প্রশস্ত ঘাট।
বাদশা-মামাকে দেখে আমার নিজেরও ভাল লাগে। সাদা গোল টুপি পরে চোখে সুরমা দিয়ে কেমন গর্বিত ভঙ্গিতে নামাজ পড়তে যান। একদিন আমাকে ডেকে একটু ইতস্তত করে বললেন, রঞ্জু, জুমার রাত্রে তাহায্তের নামাজ পড়ে শুয়েছি, আমনি দেখি তোর লালমামি যেন নৌকায় করে ফিরে আসছে। আসবে ফিরে, দেখিস তুই। বাদশা মামার চোখ আনন্দে চকচক করে।
লালমামির কথা ভাবতে চাই না আমি। তবু বড়ো মনে পড়ে। কে জানে কোথায় সংসার পেতেছে তারা; নাকি যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশময়? কোনোদিন কী সত্যি ফিরে আসবে ধসে যাওয়া পরিবারটিকে শেষবারের মত দেখে যেতে?
নিজের কথাও আজকাল খুব ভাবি। আজন্ম যে রহস্যময়তার ভেতর বড় হয়েছি তা সরে সরে যায়। মনে হয় কিছুই রহস্য নয়। চাঁদের আলো, ভোরের প্রথম সূর্য সমস্তই রহস্যের অতীত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী। যে নিয়মের ভেতর আমরা জন্মাই, বড় হই, দুঃখ-কষ্ট পাই। দুঃখ ও সুখ, কী তা নিয়েও ভাবতে চেষ্টা করি; মোহরের মা যখন তার আজীবন-সঞ্চিত পটুলা-পুটলি নিয়ে অশ্রুসজল চোখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ও ব্যাটা রঞ্জু যাই গো ব্যাটা। তোমার দুঃসময়ে একটা মানুষের বোঝা আর বাড়াইতাম না গো। তখন আমার কোন দুঃখবোধ হয় না। এ যেন ঘটতই। তাহলে দুঃখ কী? নতুন করে আবার সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে শুনে ছোট্ট নানীজান যখন উন্মাদের মত কাঁদেন তখন বুঝি এই দুঃখ, অথচ সফুরা খালা তখন হাসিমুখে বলেন, গরিব মানুষ হওয়ার অনেক রকম মজা আছে রঞ্জু, তুমি ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতে পারবে কেউ কিছু বলবে না। তখন সব ভাবনা-চিন্তা জট পাকিয়ে যায়।
সন্ধ্যাবেলা আমি নানাজানের হাত ধরে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাই। হিম গেলে তাঁর কাশি হয়। খুক খুক করে কাশেন। আমি যদি বলি, চলেন ঘরে যাই। নানাজান আঁৎকে ওঠেন, না, না, আরেকটু, আরেকটু, বেড়াই। পরম নির্ভরতার সঙ্গে তিনি আমার হাত ধরে হাঁটেন। বেলাশেষের সূর্যরশ্মি তার সফেদ দাড়িতে চকচক করে।
লিলির যে চিঠির জন্যে পরম আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছিলাম, সে চিঠি এসে গেছে। লিলি গোটা গোটা হরফে লিখছে, আমি জানি তুই রাগ করেছিস। কতদিন হল গিয়েছি কিন্তু কখনো তোর কাছে চিঠি লিখিনি। কি করব বল? এমন খারাপ অবস্থা গেছে আমার। তোর দুলাভাইয়ের চাকরি নেই। বসতবাটিও পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। একেবারে ভিক্ষা করবার মত অবস্থা। কতদিন যে মাত্র একবেলা খেয়েছি। তারপর আবার তোর দুলাভাইয়ের অসুখ হল। মরো-মারো অবস্থা। এখন অবশ্যি ঠিক হয়ে গেছে সব। তুই অতি অবশ্যি এসে যা রঞ্জু।
লিলির চিঠি পকেটে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই। সবাইকে ছেড়ে যেতে বড় মায়া লাগে। আশৈশব পরিচিত এ বাড়িঘর। বাদশা মামা, নানাজান, লালমামি, নবুমামা এদ্রের সবার স্মৃতির গন্ধ নিয়ে যে বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাকে ছেড়ে কী করে যাই? আমি উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সোনাখালির পুলের উপর অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকি। নৌকা নিয়ে চলে যাই হলদিপোতা। খুব জোছনা হলে সফুরা খালাকে নিয়ে পুকুরঘাটে বেড়াতে চাই। সফুরা খালা বলেন, তুমি কবে যাবে রঞ্জু?
যে কোনো একদিন যাব।
সেই যে কোনো একদিনটা কবে?
হবে একদিন।
একেক রাতে সফুরা খালা কাঁদেন। তার গভীর বিষাদ বুঝবার ক্ষমতা আমার নেই। বুঝতে চাই না। যে বন্ধন আমাকে এখানে আটকে রেখেছে কবে তা কাটবে, কবে চলে যাব, তাই ভাবি। নানাজানও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন,
তোমার যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে?
না।
তোমার আর লিলির নামে যে জমি-জমা আছে তার কী হবে?
যেমন আছে তেমন থাকবে।
নানাজান কথা বললেন না। আমি জানি এই জমিটুকুই তাদের অবলম্বন।
সে রাতে ভীষণ শীতই পড়েছিল। সন্ধ্যা না নামতেই ঘন কুয়াশা চারদিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। রাতের খাওয়ার পর হ্যারিকেন হাতে বাইরের ঘরে আসছি, হঠাৎ দেখি মামা দারুণ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত আসছেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।
রঞ্জু, দেখ দেখি।
আমি তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে, লালমামি একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, বাদশা মামা বলে চলেছেন, নৌকা করে সন্ধ্যার আগেই এরা দুজন এসেছে। চুপচাপ বসেছিল। আমি মসজিদে যাব বলে ওজু করতে গিয়েছি। এমন সময়…
লালমামি বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন (যে উঠানে অনেক অনেক দিন আগে আমার মা তার দুটি ছেলেমেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন)। কেউ কোনো কথা বলল না। নানাজান চিত্ৰাপিতের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। ছোট নানীজান যেন কিছুই বুঝছেন না। এমন ভঙ্গিতে
তাকাতে লাগলেন। সফুরা খালা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি নিচে নেমে এলেন। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর গরম শালটা কোথায় সফুরা? এলাচির শীত করছে।
নবুমামার কথা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। সবাই চুপ করে রইল। এক সময় দেখলাম লালমামি কাঁদছেন।
আমি চুপচাপ বাইরের ঘরে বসে বসে ঝিঝি ডাক শুনতে লাগলাম। অনেক রাতে বাদশা মামা আমাকে ডেকে নিলেন। মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, তোরা সবাই যদি দূরে দূরে থাকিস তাহলে এলাচি কী মনে করবে বল? চল রঞ্জু।
বাদশা মামা আমার হাত ধরলেন।
বহুদিন পর লালমামির ঘরে এসে ঢুকলাম। পালঙ্কে লালমামি আধশোয়া হয়ে আছেন। তার কোলের কাছে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বাচ্চা মেয়েটি ঘুমিয়ে। আমি এসে বসতেই লালমামি একটু সরে গেলেন। আমি বললাম, কেমন আছেন মামি?
মামি মাথা নাড়লেন। বাদশা মামা বললেন, মোটেই ভাল না রঞ্জু। দেখ না স্বাস্থ্য কী খারাপ হয়ে গেছে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে পুরোনো গ্রামোফোন খুঁজে বের করলেন।
আমি বললাম–
আজি থাক মামা।
না-না শুনি। আমার শোনার ইচ্ছা হচ্ছে।
লালমামি মৃদু কণ্ঠে বললেন, না-না থাকুক। গান বাজাতে হবে না।
তবু গান বেজে উঠল—
“আমার ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো
তোরে আমি কোথায় রাখি বল।”
আমি চলে আসলাম। এই অচিনপুরীতে থাকবার কাল আমার শেষ হয়েছে।
কিছু না, কিছু না।
ঢোল দিচ্ছে কে? আপনি নাকি?
হুঁ।
কিসের জন্যে?
বাদশা মামা দাঁড়িয়ে পড়লেন। জড়িত কণ্ঠে বললেন, রহমত পাগলের জন্যে ঢোল দিচ্ছি, যদি কেউ পায় তাহলে পাঁচ টাকা পুরস্কার।
কেন, কি হয়েছে?
বাদশা মামা এড়িয়ে যেতে চাইলেন। কিন্তু আমি ততক্ষণে তার হাত চেপে ধরেছি। মামা অসহায়ভাবে তাকালেন আমার দিকে। আমি দৃষ্ট গলায় বললাম, বলেন কি ব্যাপার।
রঞ্জু, পাগলটাকে খেদিয়ে দেবার পর থেকে যত অশান্তি শুরু হয়েছে। ফিরিয়ে আনলে যদি সব মিটে।
মামা আমার হাত ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। বাদশা মামা আরো অনেক রকম পাগলামি করতে লাগলেন। নানাজানের একটি আম-কাঁঠালের প্রকাণ্ড বাগান ছিল। জলের দরে সেটি বেঁচে দিলেন। বিক্রির টাকা দিয়ে নাকি মসজিদ করবেন। ছোট নানীজান কাঁদো-কাঁদো হয়ে বললেন, এসব কী রে বাদশা?
বাদশা মামা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে বললেন, তিনি নাকি স্বপ্নে দেখেছেন সাদা পোশাক পরা এক জ্যোতির্ময় পুরুষ তাকে বললেন, মসজিদ কর, সব ঠিক হবে। ছোট নানীজান বললেন, বাদশা, তুই মিথ্যা কথা বলছিস। বাদশা মামা মাথা নিচু করে চলে গেলেন। মসজিদের জন্য ইট পুড়ানো হতে লাগল। ময়মনসিংহ থেকে রাজমিস্ত্রি আসল। বিরাট মিলাদ মহফিলের মধ্যে মসজিদের কাজ শুরু হল।
নানাজানের দুটি বিল ছিল। বিলের মাছ থেকে পয়সা আসত বিস্তর। সেই টাকায় সংসার খরচ গিয়েও বেশ মোটা অংশ জমত। বিল দুটি একইসঙ্গে হাতছাড়া হয়ে গেল। কী ভাবে হল কেউ বলতে পারল না। নানীজান সারাদিন চোখের পানি ফেলতে লাগলেন।
রহিম শেখ একসঙ্গে বেশ কয়েকটি মামলা রুজু করল। সমস্তই মিথ্যা মামলা। বাদশা মামা নির্বিকার বসে আছেন মসজিদের সামনে। দেখছেন কী করে ইটের পর ইট বিছিয়ে ভিত তৈরি হচ্ছে। মামলার তদবীরের জন্য ছোট নানীজানকে নিয়ে আমিই যাওয়া-আসা করতে লাগলাম। দীর্ঘদিন মামলা চলল। দুটিতে জিত হল আমাদের, একটি রহিম শেখ পেল।
নানাজান হজ থেকে ফিরে এলেন এই সময়ে। সংসারের তখন ভরাডুবি ঘটেছে। রোজকার বাজারের টাকাতেও টানাটানি পড়তে শুরু করেছে। নানাজান কিছুই বলল না। ছয় মাসেই তার বয়স ছবছর বেড়ে গেছে। চোখের দৃষ্টি হয়েছে নিম্প্রভ, একা একা হাঁটতে পারেন না। লাঠিতে ভর না দিয়ে দাঁড়াতে পারেন না। চোখের সামনে সংসারকে ভেঙে পড়তে দেখলেন। তবু সকালেবেলায় কোরাওন শরীফ ধরে বিলম্বিত সুরে পড়তে লাগলেন। “ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বিকুমা তুকাজ্জিবান।” অতএব তুমি আমার কোন কোন নিয়ামত অস্বীকার করিবে?
বৎসর যাবার আগেই সম্পত্তির এক তৃতীয়াংশ বিক্রি করে দিতে হল। বাদশা মামার মসজিদ ততদিনে শেষ হয়েছে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে চমৎকার নকশি কাটা গম্বুজ। ধবধব সাদা দেয়ালে নীল হরফে লেখা কলমায়ে তৈয়ব। পাড়ার ছেলেমেয়েরা আমপারা হাতে সকালবেলাতেই মসজিদে ছবক নিতে আসে। দেখে-শুনে বাদশা মামা মহাখুশি। মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে মসজিদের সামনে পুকুর কাটিয়ে দিলেন। কি সুন্দর টলটলে জল, পুকুরে পাথরে বাঁধানো প্রশস্ত ঘাট।
বাদশা-মামাকে দেখে আমার নিজেরও ভাল লাগে। সাদা গোল টুপি পরে চোখে সুরমা দিয়ে কেমন গর্বিত ভঙ্গিতে নামাজ পড়তে যান। একদিন আমাকে ডেকে একটু ইতস্তত করে বললেন, রঞ্জু, জুমার রাত্রে তাহায্তের নামাজ পড়ে শুয়েছি, আমনি দেখি তোর লালমামি যেন নৌকায় করে ফিরে আসছে। আসবে ফিরে, দেখিস তুই। বাদশা মামার চোখ আনন্দে চকচক করে।
লালমামির কথা ভাবতে চাই না আমি। তবু বড়ো মনে পড়ে। কে জানে কোথায় সংসার পেতেছে তারা; নাকি যাযাবরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে দেশময়? কোনোদিন কী সত্যি ফিরে আসবে ধসে যাওয়া পরিবারটিকে শেষবারের মত দেখে যেতে?
নিজের কথাও আজকাল খুব ভাবি। আজন্ম যে রহস্যময়তার ভেতর বড় হয়েছি তা সরে সরে যায়। মনে হয় কিছুই রহস্য নয়। চাঁদের আলো, ভোরের প্রথম সূর্য সমস্তই রহস্যের অতীত প্রাকৃতিক নিয়মাবলী। যে নিয়মের ভেতর আমরা জন্মাই, বড় হই, দুঃখ-কষ্ট পাই। দুঃখ ও সুখ, কী তা নিয়েও ভাবতে চেষ্টা করি; মোহরের মা যখন তার আজীবন-সঞ্চিত পটুলা-পুটলি নিয়ে অশ্রুসজল চোখে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলে, ও ব্যাটা রঞ্জু যাই গো ব্যাটা। তোমার দুঃসময়ে একটা মানুষের বোঝা আর বাড়াইতাম না গো। তখন আমার কোন দুঃখবোধ হয় না। এ যেন ঘটতই। তাহলে দুঃখ কী? নতুন করে আবার সম্পত্তি বিক্রি হচ্ছে শুনে ছোট্ট নানীজান যখন উন্মাদের মত কাঁদেন তখন বুঝি এই দুঃখ, অথচ সফুরা খালা তখন হাসিমুখে বলেন, গরিব মানুষ হওয়ার অনেক রকম মজা আছে রঞ্জু, তুমি ইচ্ছামত ঘুরে বেড়াতে পারবে কেউ কিছু বলবে না। তখন সব ভাবনা-চিন্তা জট পাকিয়ে যায়।
সন্ধ্যাবেলা আমি নানাজানের হাত ধরে তাকে বেড়াতে নিয়ে যাই। হিম গেলে তাঁর কাশি হয়। খুক খুক করে কাশেন। আমি যদি বলি, চলেন ঘরে যাই। নানাজান আঁৎকে ওঠেন, না, না, আরেকটু, আরেকটু, বেড়াই। পরম নির্ভরতার সঙ্গে তিনি আমার হাত ধরে হাঁটেন। বেলাশেষের সূর্যরশ্মি তার সফেদ দাড়িতে চকচক করে।
লিলির যে চিঠির জন্যে পরম আগ্রহে প্রতীক্ষা করেছিলাম, সে চিঠি এসে গেছে। লিলি গোটা গোটা হরফে লিখছে, আমি জানি তুই রাগ করেছিস। কতদিন হল গিয়েছি কিন্তু কখনো তোর কাছে চিঠি লিখিনি। কি করব বল? এমন খারাপ অবস্থা গেছে আমার। তোর দুলাভাইয়ের চাকরি নেই। বসতবাটিও পদ্মায় ভেঙে নিয়েছে। একেবারে ভিক্ষা করবার মত অবস্থা। কতদিন যে মাত্র একবেলা খেয়েছি। তারপর আবার তোর দুলাভাইয়ের অসুখ হল। মরো-মারো অবস্থা। এখন অবশ্যি ঠিক হয়ে গেছে সব। তুই অতি অবশ্যি এসে যা রঞ্জু।
লিলির চিঠি পকেটে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াই। সবাইকে ছেড়ে যেতে বড় মায়া লাগে। আশৈশব পরিচিত এ বাড়িঘর। বাদশা মামা, নানাজান, লালমামি, নবুমামা এদ্রের সবার স্মৃতির গন্ধ নিয়ে যে বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে তাকে ছেড়ে কী করে যাই? আমি উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। সোনাখালির পুলের উপর অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকি। নৌকা নিয়ে চলে যাই হলদিপোতা। খুব জোছনা হলে সফুরা খালাকে নিয়ে পুকুরঘাটে বেড়াতে চাই। সফুরা খালা বলেন, তুমি কবে যাবে রঞ্জু?
যে কোনো একদিন যাব।
সেই যে কোনো একদিনটা কবে?
হবে একদিন।
একেক রাতে সফুরা খালা কাঁদেন। তার গভীর বিষাদ বুঝবার ক্ষমতা আমার নেই। বুঝতে চাই না। যে বন্ধন আমাকে এখানে আটকে রেখেছে কবে তা কাটবে, কবে চলে যাব, তাই ভাবি। নানাজানও মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন,
তোমার যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে?
না।
তোমার আর লিলির নামে যে জমি-জমা আছে তার কী হবে?
যেমন আছে তেমন থাকবে।
নানাজান কথা বললেন না। আমি জানি এই জমিটুকুই তাদের অবলম্বন।
সে রাতে ভীষণ শীতই পড়েছিল। সন্ধ্যা না নামতেই ঘন কুয়াশা চারদিকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। রাতের খাওয়ার পর হ্যারিকেন হাতে বাইরের ঘরে আসছি, হঠাৎ দেখি মামা দারুণ উত্তেজিত হয়ে দ্রুত আসছেন। আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন।
রঞ্জু, দেখ দেখি।
আমি তাকিয়ে দেখলাম একটু দূরে, লালমামি একটি বাচ্চা মেয়ের হাত ধরে বিষন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, বাদশা মামা বলে চলেছেন, নৌকা করে সন্ধ্যার আগেই এরা দুজন এসেছে। চুপচাপ বসেছিল। আমি মসজিদে যাব বলে ওজু করতে গিয়েছি। এমন সময়…
লালমামি বাচ্চা মেয়েটির হাত ধরে উঠোনে এসে দাঁড়ালেন (যে উঠানে অনেক অনেক দিন আগে আমার মা তার দুটি ছেলেমেয়ের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিলেন)। কেউ কোনো কথা বলল না। নানাজান চিত্ৰাপিতের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। ছোট নানীজান যেন কিছুই বুঝছেন না। এমন ভঙ্গিতে
তাকাতে লাগলেন। সফুরা খালা দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি নিচে নেমে এলেন। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোর গরম শালটা কোথায় সফুরা? এলাচির শীত করছে।
নবুমামার কথা কেউ কিছু জিজ্ঞেস করল না। সবাই চুপ করে রইল। এক সময় দেখলাম লালমামি কাঁদছেন।
আমি চুপচাপ বাইরের ঘরে বসে বসে ঝিঝি ডাক শুনতে লাগলাম। অনেক রাতে বাদশা মামা আমাকে ডেকে নিলেন। মৃদু ভর্ৎসনার সুরে বললেন, তোরা সবাই যদি দূরে দূরে থাকিস তাহলে এলাচি কী মনে করবে বল? চল রঞ্জু।
বাদশা মামা আমার হাত ধরলেন।
বহুদিন পর লালমামির ঘরে এসে ঢুকলাম। পালঙ্কে লালমামি আধশোয়া হয়ে আছেন। তার কোলের কাছে কুণ্ডুলি পাকিয়ে বাচ্চা মেয়েটি ঘুমিয়ে। আমি এসে বসতেই লালমামি একটু সরে গেলেন। আমি বললাম, কেমন আছেন মামি?
মামি মাথা নাড়লেন। বাদশা মামা বললেন, মোটেই ভাল না রঞ্জু। দেখ না স্বাস্থ্য কী খারাপ হয়ে গেছে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। বাদশা মামা ব্যস্ত হয়ে পুরোনো গ্রামোফোন খুঁজে বের করলেন।
আমি বললাম–
আজি থাক মামা।
না-না শুনি। আমার শোনার ইচ্ছা হচ্ছে।
লালমামি মৃদু কণ্ঠে বললেন, না-না থাকুক। গান বাজাতে হবে না।
তবু গান বেজে উঠল—
“আমার ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো
তোরে আমি কোথায় রাখি বল।”
আমি চলে আসলাম। এই অচিনপুরীতে থাকবার কাল আমার শেষ হয়েছে।
---সমাপ্ত---
No comments