হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস "অচিনপুর" চতুর্থ-পর্ব । @মিঃ মধু
---অচিনপুর---
(চতুর্থ-পর্ব)
রাজশাহী থেকে খবর এল, স্কুল ফাইন্যাল দিয়েই নবুমামা কাউকে কিছু না বলে কলকাতা চলে গেছেন। নানাজানের মুখ গম্ভীর হল। নানীজনের কেন জানি ধারণা, নবুমামা আর কখনো ফিরবে না। তিনি গানের মত সুরে যখন কাঁদতে থাকেন তখন বলেন, এক মেয়ে পাগল, এক ছেলে বিরাগী, এক বউ বাঁজা।
শুনলে হাসি পায়, আবার দুঃখও লাগে। বাদশা মামা মাঝে-মধ্যে গিয়ে নানীজনকে ধমক দেন, কি মা, আপনি সব সময় বাঁজা বউ বাঁজা বউ করেন!
নানীজান ক্ষেপে গিয়ে বলেন,
ও বাঁজা বউকে আমি আর কি বলে ডাকব?
আহা, এলাচি মনে কষ্ট পায়।
নানীজনে কপালে করাঘাত করেন। আর বলেন,
হা রে বউ, তুই কি জাদুটাই না করলি!
বাদশা মামা চিন্তিত, বিরক্ত আর ক্লান্তমুখে চলে আসেন।
নবুমামা হঠাৎ করে কলকাতা চলে যাওয়ায় খুশি মনে হয় শুধু সফুরা খালাকে। আমাকে ডেকে বলেন, আমি ছেলে হলে নবুর মত কাউকে না বলে আমিও চলে যেতাম।
আট-দশ দিন পর নবুমামা কলকাতা থেকে টাকা চেয়ে পাঠাল। নানাজান লোক মারফত টাকা পাঠালেন। নির্দেশ রইল, ঘাড় ধরে যেন তাকে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, নবুমামাকে বিয়ে দেওয়া হবে। নানাজান মেয়ে দেখতে লাগলেন। নানীজান মহাখুশি। লালমামিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, নতুন বউয়ের এক বৎসরের ভিতর ছেলে হবে–আমি স্বপ্ন দেখেছি।
টাকা নিয়ে লোক যাওয়ার কয়েকদিন পরেই নবুমামা এসে পড়লেন। সরাসরি এসে বাড়িতে তিনি উঠলেন না, লোক মারফত খবর পাঠালেন কাউকে কিছু না বলে আমি যেন আজিজ খাঁর বাড়িত চলে আসি।
আজিজ খাঁর বাইরের ঘরের চেয়ারে নবুমামা গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। মাথায় বেড়েছেন কিছু। গায়ের রঙ ফর্সা হয়েছে। আমাকে দেখে রহস্যময় হাঁসি হাসলেন, বাড়িতে কেউ জানে না তো আমি এসেছি যে?
না।
গুড।
কি ব্যাপার নবুমামা?
একটা প্ল্যান করেছি। রঞ্জু। লালমামিকে একবার চমকে দেব। গ্রামোফোন কিনেছি একটা। ঐ দেখ টেবিলে।
আমি হা করে টেবিলে রেখে দেয়া বিচিত্র যন্ত্রটি তাকিয়ে দেখি। নবুমামা হাসি মুখে বলেন, পাঁচটা রেকর্ড আছে। একশ পনের টাকা দাম।
নবুমামার প্ল্যান শুনে আমার উৎসাহের সীমা থাকে না। রাতের বেলায় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নবুমামা গ্রামোফোন নিয়ে চুপি চুপি যাবেন। যে ঘরটায় আমি আর নবুমামা থাকি সেই ঘরটায় চুপ চুপি এসে গ্রামোফোন বাজানোর ব্যবস্থা করা হবে। গান শুনে হকচাকিয়ে বেরিয়ে আসবেন লালমামি। অবাক হয়ে বলবেন,
রঞ্জ কি হয়েছে রে, গান হয় কোথায়?
তখন হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবেন নবুমামা। উৎসাহে নবুমামা টগবগ করছেন। আমি বললাম,
নবু মামা, এখন একটা গান শুনি।
নবুমামা হা হা করে ওঠেন, না না, এখন না। পরে শুনবি। ফাস্টে কোনটা বাজাব বল ত?
কি করে বলব, কোনটা?
সেদিন সন্ধ্যার আগে-ভাগেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল। সে কি বৃষ্টি! ঘরদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। নবুমামা বিরক্ত মুখে বসে। রইলেন। রাতের খাওয়া-দাওয়া আজিজ খাঁর ওখানেই হল।
রাত যখন অনেক হয়েছে, লোকজন শুয়ে পড়েছে, সবখানে, তখন আমরা উঠলাম। বৃষ্টি থামেনি, গুড়ি গুড়ি পড়ছেই। মাথায় ছাতা ধরে আধভেজা হয়ে বাড়িতে উঠলাম। কাদায়-পানিতে মাখামাখি। বাড়িতে জেগে কেউ নেই। শুধু নানাজানের ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে। দুজনে নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলাম। দরজা খোলা হল অত্যন্ত সাবধানে। একটু ক্যাচ শব্দ হতেই দুজনে চমকে উঠছি।
অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে বের করলেন নবুমামা। বহু কষ্ট করে চোঙ্গ ফিট করা হল। দম দিতে গিয়ে বিপত্তি, ঘাস ঘ্যাস শব্দ হয়। তবে ভরসার কথা, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। নবুমামা ফিসফিসিয়ে বললেন, কোন গানটা দিয়েছি কে জানে। একটা খুব বাজে গান আছে। এটা প্রথমে এসে গেলে খারাপ হবে খুব।
আমি বললাম, নবুমামা, দেরি করছি কেন?
দিচ্ছি। বৃষ্টিটা একটু কমুক, নয়ত শুনবে না।
বৃষ্টির বেগ একটু কমে আসতেই গান বেজে উঠল,
আমার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো
তোরে আমি কোথায় রাখি বল।
লালমামি গান শুনে মুগ্ধ হবে কি, আমি নিজেই মোহিত হয়ে গেলাম। কি অপূর্ব কিন্নর কণ্ঠে গান হচ্ছে। বাইরে ঝমকামিয়ে বৃষ্টি। আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল।
নবুমামা ফিসফিসিয়ে বললেন, কি ব্যাপার, ভাবী আসে না যে? ও রঞ্জু।
আমি সে কথায় জবাব দিলাম না। বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। জানালার কপাটে শব্দ খট খট। নবুমামা জানালা বন্ধ করবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি লালমামি ডাকলেন,
রঞ্জু, রঞ্জু!
নবুমামা ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে থাক, কথা বলবি না। আমি চুপ করে রইলাম। নবুমামা অন্য রেকর্ড চালিয়ে দিল—
‘যদি ভাল না লাগে তো দিও না মন’
লালমামি দরজায় ঘা দিলেন, ও রঞ্জু, কি ব্যাপার, গান হয় কোথায়? নবুমামা উত্তেজনায় চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন, ভাবী তোমার জন্য আনলাম। তোমার জন্য আনলাম। নবুমামা লালমামির হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। কি ফুর্তি তার! লালমামি বললেন, কলের গান না? ছোটবেলায় দেখেছিলাম একবার। চোঙ আছে? বাতি জ্বালাও না।
বাতি জ্বালানো হল। লালমামিকে দেখব কি? নবুমামার দিকেই তাকিয়ে আছি। আনন্দে উত্তেজনায় নবুমামার চোখ জ্বল জ্বল করছে। মামি বললেন, ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো গানটা আরেকবার দাও।
সেই অপূর্ব গান আবার বেজে উঠল। বাইরে তখন ঝড়-বৃষ্টি।
সে রাতের কথা আমার খুব মনে আছে।
একটি মানুষের সামগ্রিক জীবনে মনে রাখবার মত ঘটনা তো খুব সীমিত। কত মানুষ আছে, সমস্ত জীবন কেটে যায় কোনো ঘটনাহ মনে রাখার মত আবেগ তার ভেতরে সৃষ্টি করে না। আমি নিজে কত কিছুই তো ভুলে বসে আছি। কিন্তু মনে আছে, সে রাতে গান শুনতে নিজের অজান্তেই আমার চোখে পানি এসেছিল। নবুমামা আর লালমামি যেন দেখতে না পায় সে জন্যে মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। নবুমামা বললেন,
ভাবী, আমার নাচতে মন চাইছে।
নাচ না।
নবুমামা বললেন,
রঞ্জু, তুই নাচবি আমার সঙ্গে?
আমি সে কথার জবাব দিলাম না। মামি বললেন,
নবু, ঐ রেকর্ডটা আবার।
সারারাত হবে আজকে। বুঝলে ভাবী।
ক্লান্তি নেই নবুমামার। লালমামির উৎসাহও সীমাহীন। শুনতে শুনতে আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। নবুমামা বললেন, গাধা! এত ফাইন গান আর ঘুমায় কেমন দেখ।
লালমামি বললেন,
আজ তাহলে থাক। ঘুমো তোরা।
না না, থাকবে না। যতক্ষণ ঝড়-বৃষ্টি হবে ততক্ষণই গান হবে। কথা শেষ হতে-না হতেই কড় কড় করে বাজ পড়ল।
ফুর্তিতে নবুমামা হো হো করে হেসে ফেললেন। মামি বললেন, রঞ্জু, ঘুম পাচ্ছে। এগুলি নিয়ে আমার ঘরে এসে পড়, নবু আমাকে ভাঙা ঘরের চাঁদের আলো গানটা শুনে শুনে লিখে দিতে পারবি কাগজে?
নিশ্চয়ই পারব। নিশ্চয়ই।
জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছিল, উঠে বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বড় নানীজনের ঘরের লাগোয়া গাব গাছটি ভেঙে পড়ে গেছে। কেমন নেড়া দেখাচ্ছে জায়গাটা। ভালই ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস থেমে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। কে জানে গতবারের মত এবারেও হয়ত বান ডাকবে। গতবার এ রকম সময়ে বাড়ি থেকে নদীর শো শো শব্দ শোনা গেছে। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনি, নবুমামা বলছেন, ভাবী, তুমিও গাও। সঙ্গে, সঙ্গে–
না না, আমি পারব না। তুই গা, মাটি সে পৌরনটা গা।
নবুমামা হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন—
মাটি মে পৌরন, মাটি মে শ্রাবণ
মাটি মে তনবিন যায়গা
যব মাটি সে সব মিল জায়গা।
গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লালমামি বললেন, দক্ষিণের জানালা বন্ধ কর নবু, ভিজে যাচ্ছি।
নবুমামা বললেন, বাদশা ভাই কোথায়?
দু’দিন ধরে দেখা নেই। কোথায় কে জানে। যদি ভাল না লাগে গানটা দে। ঘুম আসছে যে আবার। ও নবু, তোর ঘুম পায় না?
শুনতে শুনতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমুতে ইচ্ছে করছিল। শুয়ে শুয়ে গান শুনতে কি ভালোই না লাগে! ক্রমে ক্রমে ঝড়ের মত বাতাসের বেগ হল। বাড়ির লম্বা থামে বাতাসের শো শো শব্দ উঠতে লাগল। ধরাম ধরাম শব্দ করে দরজা নড়তে লাগল। উঠে দাঁড়িয়েছি হ্যাঁরিকেন জ্বালাব বলে, ওমনি সফুরা খালা ডাকলেন,
রঞ্জু, ও রঞ্জু!
দরজা খুলে দেখি সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে সফুরা খালা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, এদিকে গান হচ্ছে না-কি রঞ্জু?
হ্যাঁ, নবুমামা কলের গান বাজাচ্ছিলেন। কলেব গান এনেছেন নবুমামা।
নবু, কোথায়?
লালমামি আর নকুমামা গান বাজাচ্ছেন।
সফুরা খালা আরো একটু এগিয়ে এসে বললেন, কই গান শুনছি না তো?
আমরা দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। সফর খালা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, রঞ্জু, আমার ভীষণ ভয় লাগছে!
সেই অপূর্ব বৃষ্টিস্নাত রাতে যে ভয় করবার মতু কিছু-একটা লুকিয়ে ছিল তা আমি বুঝতে পারি নি। সফুব খালা শীতে কঁপিছিলেন, তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবু শুধুমাত্র তার কথা শুনেই ধারণা হল, কোথাও নিশ্চযই ভয় লুকিয়ে আছে।
সফুরা খালা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত চলে গেলেন যেন কোন হিংস্র জন্তু তাকে তাড়া কবছে। মাতালের মত বেসামাল পদক্ষেপ। আমি এসে গুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। মেঘ কেটে গেছে, রোদ উঠছে ঝকঝকে। জানোলা দিয়ে বাইরে তাকালেই মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব কি-না ভাবছি, তখন নবুমামা এসে ডাকলেন, আয়, মাছ ধরতে যাই। নতুন পানিতে মেলা মাছ এসেছে।
ছিপ, কানিজাল ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে নৌকা করে চললাম দুজনে হলদাপোতা। কিন্তু নবুমামার মাছ মারার মন ছিল না। অপ্রাসঙ্গিক নানা কথা বলতে লাগল। দুপুর পর্যন্ত আমরা ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম। নবুমামার ভাবভঙ্গি আমার কাছে কেমন কেমন লাগল। তিনি যেন বিশেষ কোন কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিয়ের কথা বললে কিশোরী মেয়েরা যেমন পালিয়ে গিয়ে লজ্জায় লাল হয অনেকটা সে বকম। নবুমামা বললেন, রঞ্জু, আমি আর পড়াশুনা করব না।
কেন?
ভাল লাগে না।
কি করবেন তবে?
ব্যবসা করব। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াব।
নানাজান মানবে না।
আমি কারো ধার ধারি না-কি?
বলতে বলতে নবুমামা ঈষৎ হাসলেন। দুপুরে খাওয়ার জন্যে চিড়া আর নারিকেল আনা হয়েছিল। তা-ই খাওয়া হল। হালদাপোতা থেকে আমরা আরো উত্তরে সরে গেলাম।
আমার আর ভাল লাগছিল না, রোদে গা তেতে উঠেছে। ইচ্ছে হচ্ছে ফিরে যাই কিন্তু নবুমামা বার বার বলছেন, একটা বড় মাছ ধরি আগে।
সন্ধার আগে আগে প্রকাণ্ড একটা কাতলা মাছ ধরা পড়ল। সুগঠিত দেহে কালচে আঁশ বেলাশেষের রোদে ঝকমক করছে। নৌকার পাটাতনে মাছটা ধড়ফড় করতে লাগল। দুজনেই মহাখুশি। নবুমামা খুব যত্নে বড়শি খুলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি বললাম, চলুন ফিরে চলি।
চল।
ভাটার টানে নৌকা ভেসে চলেছে। হঠাৎ করে নবুমামার ভাবান্তর হল। আমার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, মাছটা ছেড়ে দেই রঞ্জু?
কেন মামা!
না, ছেড়ে দি।
বলেই মাছটা জলে ফেললেন। আমি চুপ করে রইলাম। নবুমামা বললেন, একবার আমি একটা পাখি ধরেছিলাম। টিয়া পাখি। তারপর কি মনে করে ছেড়ে দিয়েছি। আমার খুব লাভ হয়েছিল।
কি লাভ?
হয়েছিল। আজকে মাছটা ছেড়ে দিলাম! দেখিস, মাছটা দোয়া করবে আমার জন্যে।
নবুমামা পাটাতনে শুয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
বাড়ি এসে হুলস্কুল কাণ্ড। লালমামির সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে সফুরা খালার। লালমামি টেনে সফুরা খালার একগোছা চুল তুলে ফেলেছেন, গাল আঁচড়ে দিয়েছেন। সফুরা খালা বিষম দৃষ্টিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লালমামি তার দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। কারে সঙ্গে কথাবার্তা নেই। বাদশা মামা আধময়লা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে বলছেন, সবাই যদি এলাচির সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে বেচারি কি কববে? কেউ দেখতে পারে না। ছোট নানীজান শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। এবার ধমকে দিলেন, যা তুই, খামাখা ঘ্যান ঘ্যান। ভাল্লাগে না।
বাদশা মামা উঠানে গিয়ে বসে রইলেন। বোকাব মত তাকাতে লাগলেন। এদিক-সেদিক। নবুমামাকে দেখে বললেন, দেখলি নবু? সফুরা কি ঝগড়া করল। এলাচির সারাদিন খাওয়া নাই।
রাতের খাওয়া শেষ হতে অনেক রাত হল। রান্না হতে দেরি হয়েছে। সংসার যাত্রা কিছু পরিমাণে বিপর্যস্ত। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমুতে এসে দেখি, সফুরা খালা বসে আছেন আমাদের ঘরে। সফুরা খালা বললেন, তোমাদের জন্যে বাইরের বাংলাঘরে বিছানা হয়েছে। এ ঘরে আমি থাকব। তাকিয়ে দেখি পরিপাটি করে ঘর সাজানো। আমার আর নবুমামার ব্যবহারিক জিনিসপত্র কিছুই নেই। নবুমামা বললেন, তুই থাকবি কেন এখানে? তোর নিজের ঘর কি হল?
আমার ঘরে পানি পড়ে, বিছানা ভিজে যায়।
নবুমামা কিছুক্ষণ উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হন হন করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। সফুরা খালা বললেন, রঞ্জু, তুমি নবুকে চোখে চোখে রাখবে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বাদশা মামার সঙ্গে দেখা। বাদশা মামা বললেন, রঞ্জু, এলাচি ভাত খেয়েছে কিনা জানিস?
জানি না।
মোহরের মা বলল, খেয়েছে। তুই একটু খোঁজ নিয়ে আয়।
আপনি নিজে যান না মামা।
আচ্ছা, আচ্ছা আমি নিজেই যাই।
লালমামি সেদিন না খেয়ে ছিলেন। রাতেও খেলেন না, দুপুরেও ভাত নিয়ে গিয়ে মোহরের মা ফিরে এল। সফুরা খালা অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। কিছু লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত নানাজান আসলেন। বিরক্ত ও দুঃখিত কণ্ঠে বললেন, এ সব কি বউ?
লালমামি কথা বললেন না। নানাজান বললেন,
খাও খাও, ভাত খাও।
না, খাব না।
সমস্ত দিন কেটে গেল। সফুরা খালা কাঁদতে লাগলেন। কি বিশ্ৰী অবস্থা! বাদশা মামা নৌকা করে গিয়েছে শ্ৰীপুরে। লালমামির মাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন একেবারে।
কানাবিবি বার বার বলে, বউ-এর কোনো খারাপ বাতাস লেগেছে, না হলে এমন হয়। মুকন্দ ওঝাকে খবর দেও না একবার।
লালমামির মা খবর পেয়েই এসে পড়লেন। লালমামি বলল, না আমি কিছুতেই খাব না। এ বাড়িতে কিছু খাব না। আমি। নানাজান বললেন, আচ্ছা, মেয়েকে না হয় নিয়েই যান। কদিন থেকে সুস্থ হয়ে আসুক।
ধরাধরি করে লালমামিকে নৌকায় তোলা হল। নৌকার পাটাতনে বাদশা মামা তার সুটকেস নিয়ে আগে থেকেই বসে আছেন। লালমামি বাদশা মামাকে দেখেই জ্বলে উঠলেন।
ও গেলে আমি যাব না। আল্লাহর কসম আমি যাব না।
বাদশা মামা চুপচাপ নেমে পড়ে দাঁড়িয়ে বোকার মত সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। যেন কিছুই হয়নি। তার কাণ্ড দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।
নবুমামার বিয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সবাই। মেয়ে তো আগেই ঠিক করা ছিল। এবার কথাবার্তা এগুতে লাগল। নানাজান অনেক রকম মিষ্টি, হলুদ রঙের শাড়ি ও কানের দুল নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে গেলেন। সঙ্গে গেলেন হেড মাস্টার সাহেব, আজিজ আলী সাহেব। আমিও গেলাম তাদের সঙ্গে। কি মিষ্টি মেয়ে শ্যামলা রঙ, বড় বড় চোখ। এক নজর দেখলেই মন ভরে ওঠে। দেখে আমার বড় ভাল লাগল। পৌষ মাসের মাঝামাঝি দিন ফেলে নানাজান উঠে এলেন।
বাড়িতে একটি চাপা আনন্দের স্রোত বইতে লাগল। সবচেয়ে খুশি সফুরা খালা। হাসি-হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সবার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে গল্প করছেন। নবুমামার কিন্তু ভাবান্তর নেই। কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। মাছ ধরতে যান। কোথাও যাত্ৰা টাত্রার খবর পেলে যাত্রা শুনতে যান।
গ্রামের মাঠে ফুটবল নেমে গেছে। সারা বিকাল কাটান ফুটবল খেলে। সেনটার ফরোয়ার্ডে তিনি দাঁড়ালে প্রতিপক্ষ তটস্থ হয়ে থাকে। শিল্ডের অনেক খেলা শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের টিম খুব শক্ত। ফাইন্যালে উঠে যাবে, সন্দেহ নেই। নবুমামা প্ৰাণপণে খেলেন। মরণপণ খেলা। বল নিয়ে দৌড়ে যাবার সময় তার মাথার লম্বাচুল বাতাসে থারথারিয়ে কাপে। মাঠের বাইরে বসে বসে মুগ্ধ নয়নে আমি তাই দেখি। রাতের বেলা গরম পানি করে আনি, নবুমামা গরম পানিতে পা ডুবিয়ে অন্যমনস্কভাবে নানা গল্প করেন। লালমামির প্রসঙ্গে কোনো আলাপ হয় না। তিনি সেই যে গিয়েছিলেন আর ফেরার নাম নেই। বাদশা মামা প্রতি হাটবারে নৌকা নিয়ে চলে যান। আবার সেদিনই ফিরে আসেন। লালমামির ঘরেই বাকি সময়টা কাটে তার। আমি বুঝতে পারি, কোথায়ও সুর কেটে গিয়েছে। ভাল লাগে না। কবে লিলির চিঠি আসবে, কবে আমি চলে যেতে পারব, তাই ভাবি। তখন আমি অনেক স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকতে ঘেন্না বোধ হচ্ছে অথচ বেরিয়ে আসতে পারছি না। বড় নানীজান অনেক সম্পত্তি না-কি আমাকে আর লিলিকে দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে আমার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তাছাড়া সে সময় আমি প্রেমেও পড়েছিলাম। অচিনপুরের এই কাহিনীতে সে প্রেমের উল্লেখ না করলেও চলে, কারণ তার ভূমিকা নেই এখানে। তবে প্রচণ্ড পরিবর্তন হচ্ছিল আমার মধ্যে এইটুকু বলা আবশ্যক।
নবুমামার স্কুল ফাইন্যালের রেজাল্ট হল তখন। খুবই ভাল রেজাল্ট। ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেলেন। কলেজে ভর্তি হবার জন্যে টাকা-পয়সা নিয়ে নবুমামা রওনা হলেন। নানাজানের ইচ্ছা ছিল নবুমামা যেন আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু নবুমামার ইচ্ছে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
নবুমামার বিয়ের তারিখ ঠিকই থাকল। নবুমামা নিজেও একদিন মেয়ে দেখে এলেন। সফুরা খালা যখন বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে? নবুমামা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছে।
বারোই ভাদ্র তারিখে নবুমামা চলে গেলেন। আর তেরোই ভদ্র বাদশা মামা শ্ৰীপুর থেকে আধ-পাগল হয়ে ফিরে এলেন। আমি ভাসা ভাসা ভাবে শুনলাম, লালমামি শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবার নাম করে নবুমামার সঙ্গে চলে গিয়েছেন।
কেউ যেন জানতে না পারে সেই জন্যে বাদশা মামাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হল। তার ঠিক নেই, কখন কাকে কি বলে বসেন। ছোট নানিজানের ফিটের ব্যারাম হয়ে গেল। সফুরা খালাকে দেখে কোন পরিবর্তন নজরে পড়ে না। শুধু তার চোখে কালি পড়েছে। মুখ শুকিয়ে তাকে দেখায় বাচ্চা ছেলের মত।
নানাজান সেই বৎসরেই হজ করতে গেলেন; যাওয়ার আগে সব সম্পত্তি বিলি বন্দোবস্ত হল। বাদশা মামাকে সব লিখে-পড়ে দিয়ে গেলেন।
একটি প্রচণ্ড প্রাচীন বটগাছ যেন চোখের সামনে শুকিয়ে উঠেছে। সবুজ পাতা ঝরে যাচ্ছে, কাণ্ড হয়েছে অশক্ত। আমি তাই দেখছি তাকিয়ে তাকিয়ে। শৈশবের যে অবুঝ ভালবাসায় নানাজানের বাড়িটিকে আমি ঘিরে রেখেছিলাম, সেই ভালবাসা করুণ নয়নে চেয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু আমি তো এখানের কেউ নই। একদিন চুপচাপ চলে যাব। কেউ জানতেও পারবে না রঞ্জু নামের আবেগপ্রবণ ছেলেটি কোথায় চলে গেল।
এ বাড়ির সব কিছুই বদলে গেছে। লাল ফেজটুপি পরা নানাজান সূর্য উঠার আগেই উঠোনের চেয়ারে এসে আর বসে না। “ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বি কুমা তুকাজ্জিবান” ঘুম-ঘুম চোখে অর্ধ-জাগ্রত কানে কতবার শুনেছি এই সুর। এখন সকালটা বড়ো চুপচাপ।
ভোরের আলোয় মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আমি চাই এ বাড়ির সবার মনের গ্লানি কেটে যাক। নবুমামা ফিরে এসে আগের মত জোছনা দেখে উল্লাসে চিৎকার করুক। কি জোছনা! খেতে ইচ্ছে করে। সফুরা খালা ঠিক আগের মত লাঠি হাতে পাখি উড়ে গেল বলে এ সংসারের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট উড়িয়ে দিক। বাদশা মামা তার সাজ-পোশাক পরে হিরণ্য রাজার পাঠ করুক। কিন্তু তা আর হবে না, তা হবার নয়। আমি সংসারের মন্থর স্রোতে গা এলিয়ে দিলাম। কারো সঙ্গেই আজ আমার যোগ নেই। দিন কেটে যেতে লাগল।
শুনলে হাসি পায়, আবার দুঃখও লাগে। বাদশা মামা মাঝে-মধ্যে গিয়ে নানীজনকে ধমক দেন, কি মা, আপনি সব সময় বাঁজা বউ বাঁজা বউ করেন!
নানীজান ক্ষেপে গিয়ে বলেন,
ও বাঁজা বউকে আমি আর কি বলে ডাকব?
আহা, এলাচি মনে কষ্ট পায়।
নানীজনে কপালে করাঘাত করেন। আর বলেন,
হা রে বউ, তুই কি জাদুটাই না করলি!
বাদশা মামা চিন্তিত, বিরক্ত আর ক্লান্তমুখে চলে আসেন।
নবুমামা হঠাৎ করে কলকাতা চলে যাওয়ায় খুশি মনে হয় শুধু সফুরা খালাকে। আমাকে ডেকে বলেন, আমি ছেলে হলে নবুর মত কাউকে না বলে আমিও চলে যেতাম।
আট-দশ দিন পর নবুমামা কলকাতা থেকে টাকা চেয়ে পাঠাল। নানাজান লোক মারফত টাকা পাঠালেন। নির্দেশ রইল, ঘাড় ধরে যেন তাকে নিয়ে আসা হয়। বাড়িতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, নবুমামাকে বিয়ে দেওয়া হবে। নানাজান মেয়ে দেখতে লাগলেন। নানীজান মহাখুশি। লালমামিকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, নতুন বউয়ের এক বৎসরের ভিতর ছেলে হবে–আমি স্বপ্ন দেখেছি।
টাকা নিয়ে লোক যাওয়ার কয়েকদিন পরেই নবুমামা এসে পড়লেন। সরাসরি এসে বাড়িতে তিনি উঠলেন না, লোক মারফত খবর পাঠালেন কাউকে কিছু না বলে আমি যেন আজিজ খাঁর বাড়িত চলে আসি।
আজিজ খাঁর বাইরের ঘরের চেয়ারে নবুমামা গম্ভীর হয়ে বসে ছিলেন। মাথায় বেড়েছেন কিছু। গায়ের রঙ ফর্সা হয়েছে। আমাকে দেখে রহস্যময় হাঁসি হাসলেন, বাড়িতে কেউ জানে না তো আমি এসেছি যে?
না।
গুড।
কি ব্যাপার নবুমামা?
একটা প্ল্যান করেছি। রঞ্জু। লালমামিকে একবার চমকে দেব। গ্রামোফোন কিনেছি একটা। ঐ দেখ টেবিলে।
আমি হা করে টেবিলে রেখে দেয়া বিচিত্র যন্ত্রটি তাকিয়ে দেখি। নবুমামা হাসি মুখে বলেন, পাঁচটা রেকর্ড আছে। একশ পনের টাকা দাম।
নবুমামার প্ল্যান শুনে আমার উৎসাহের সীমা থাকে না। রাতের বেলায় সবাই ঘুমিয়ে পড়লে নবুমামা গ্রামোফোন নিয়ে চুপি চুপি যাবেন। যে ঘরটায় আমি আর নবুমামা থাকি সেই ঘরটায় চুপ চুপি এসে গ্রামোফোন বাজানোর ব্যবস্থা করা হবে। গান শুনে হকচাকিয়ে বেরিয়ে আসবেন লালমামি। অবাক হয়ে বলবেন,
রঞ্জ কি হয়েছে রে, গান হয় কোথায়?
তখন হো হো করে হাসতে হাসতে বেরিয়ে আসবেন নবুমামা। উৎসাহে নবুমামা টগবগ করছেন। আমি বললাম,
নবু মামা, এখন একটা গান শুনি।
নবুমামা হা হা করে ওঠেন, না না, এখন না। পরে শুনবি। ফাস্টে কোনটা বাজাব বল ত?
কি করে বলব, কোনটা?
সেদিন সন্ধ্যার আগে-ভাগেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নামল। সে কি বৃষ্টি! ঘরদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হু হু করে ঝড়ো হাওয়া বইতে লাগল। নবুমামা বিরক্ত মুখে বসে। রইলেন। রাতের খাওয়া-দাওয়া আজিজ খাঁর ওখানেই হল।
রাত যখন অনেক হয়েছে, লোকজন শুয়ে পড়েছে, সবখানে, তখন আমরা উঠলাম। বৃষ্টি থামেনি, গুড়ি গুড়ি পড়ছেই। মাথায় ছাতা ধরে আধভেজা হয়ে বাড়িতে উঠলাম। কাদায়-পানিতে মাখামাখি। বাড়িতে জেগে কেউ নেই। শুধু নানাজানের ঘরে আলো দেখা যাচ্ছে। দুজনে নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলাম। দরজা খোলা হল অত্যন্ত সাবধানে। একটু ক্যাচ শব্দ হতেই দুজনে চমকে উঠছি।
অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে বের করলেন নবুমামা। বহু কষ্ট করে চোঙ্গ ফিট করা হল। দম দিতে গিয়ে বিপত্তি, ঘাস ঘ্যাস শব্দ হয়। তবে ভরসার কথা, ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নেমেছে। নবুমামা ফিসফিসিয়ে বললেন, কোন গানটা দিয়েছি কে জানে। একটা খুব বাজে গান আছে। এটা প্রথমে এসে গেলে খারাপ হবে খুব।
আমি বললাম, নবুমামা, দেরি করছি কেন?
দিচ্ছি। বৃষ্টিটা একটু কমুক, নয়ত শুনবে না।
বৃষ্টির বেগ একটু কমে আসতেই গান বেজে উঠল,
আমার ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো
তোরে আমি কোথায় রাখি বল।
লালমামি গান শুনে মুগ্ধ হবে কি, আমি নিজেই মোহিত হয়ে গেলাম। কি অপূর্ব কিন্নর কণ্ঠে গান হচ্ছে। বাইরে ঝমকামিয়ে বৃষ্টি। আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠল।
নবুমামা ফিসফিসিয়ে বললেন, কি ব্যাপার, ভাবী আসে না যে? ও রঞ্জু।
আমি সে কথায় জবাব দিলাম না। বাইরে তখন ঝড় উঠেছে। জানালার কপাটে শব্দ খট খট। নবুমামা জানালা বন্ধ করবার জন্যে উঠে দাঁড়িয়েছে, অমনি লালমামি ডাকলেন,
রঞ্জু, রঞ্জু!
নবুমামা ফিসফিস করে বললেন, চুপ করে থাক, কথা বলবি না। আমি চুপ করে রইলাম। নবুমামা অন্য রেকর্ড চালিয়ে দিল—
‘যদি ভাল না লাগে তো দিও না মন’
লালমামি দরজায় ঘা দিলেন, ও রঞ্জু, কি ব্যাপার, গান হয় কোথায়? নবুমামা উত্তেজনায় চেপে রাখতে না পেরে হো হো করে হেসে উঠলেন, ভাবী তোমার জন্য আনলাম। তোমার জন্য আনলাম। নবুমামা লালমামির হাত ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে গেল। কি ফুর্তি তার! লালমামি বললেন, কলের গান না? ছোটবেলায় দেখেছিলাম একবার। চোঙ আছে? বাতি জ্বালাও না।
বাতি জ্বালানো হল। লালমামিকে দেখব কি? নবুমামার দিকেই তাকিয়ে আছি। আনন্দে উত্তেজনায় নবুমামার চোখ জ্বল জ্বল করছে। মামি বললেন, ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো গানটা আরেকবার দাও।
সেই অপূর্ব গান আবার বেজে উঠল। বাইরে তখন ঝড়-বৃষ্টি।
সে রাতের কথা আমার খুব মনে আছে।
একটি মানুষের সামগ্রিক জীবনে মনে রাখবার মত ঘটনা তো খুব সীমিত। কত মানুষ আছে, সমস্ত জীবন কেটে যায় কোনো ঘটনাহ মনে রাখার মত আবেগ তার ভেতরে সৃষ্টি করে না। আমি নিজে কত কিছুই তো ভুলে বসে আছি। কিন্তু মনে আছে, সে রাতে গান শুনতে নিজের অজান্তেই আমার চোখে পানি এসেছিল। নবুমামা আর লালমামি যেন দেখতে না পায় সে জন্যে মাথা ঘুরিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রয়েছি। নবুমামা বললেন,
ভাবী, আমার নাচতে মন চাইছে।
নাচ না।
নবুমামা বললেন,
রঞ্জু, তুই নাচবি আমার সঙ্গে?
আমি সে কথার জবাব দিলাম না। মামি বললেন,
নবু, ঐ রেকর্ডটা আবার।
সারারাত হবে আজকে। বুঝলে ভাবী।
ক্লান্তি নেই নবুমামার। লালমামির উৎসাহও সীমাহীন। শুনতে শুনতে আমার ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। নবুমামা বললেন, গাধা! এত ফাইন গান আর ঘুমায় কেমন দেখ।
লালমামি বললেন,
আজ তাহলে থাক। ঘুমো তোরা।
না না, থাকবে না। যতক্ষণ ঝড়-বৃষ্টি হবে ততক্ষণই গান হবে। কথা শেষ হতে-না হতেই কড় কড় করে বাজ পড়ল।
ফুর্তিতে নবুমামা হো হো করে হেসে ফেললেন। মামি বললেন, রঞ্জু, ঘুম পাচ্ছে। এগুলি নিয়ে আমার ঘরে এসে পড়, নবু আমাকে ভাঙা ঘরের চাঁদের আলো গানটা শুনে শুনে লিখে দিতে পারবি কাগজে?
নিশ্চয়ই পারব। নিশ্চয়ই।
জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট আসছিল, উঠে বন্ধ করতে গিয়ে দেখি বড় নানীজনের ঘরের লাগোয়া গাব গাছটি ভেঙে পড়ে গেছে। কেমন নেড়া দেখাচ্ছে জায়গাটা। ভালই ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। বাতাস থেমে গেলেও বৃষ্টি পড়ছে মুষলধারে। কে জানে গতবারের মত এবারেও হয়ত বান ডাকবে। গতবার এ রকম সময়ে বাড়ি থেকে নদীর শো শো শব্দ শোনা গেছে। চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে শুয়ে শুনি, নবুমামা বলছেন, ভাবী, তুমিও গাও। সঙ্গে, সঙ্গে–
না না, আমি পারব না। তুই গা, মাটি সে পৌরনটা গা।
নবুমামা হেঁড়ে গলায় গান ধরলেন—
মাটি মে পৌরন, মাটি মে শ্রাবণ
মাটি মে তনবিন যায়গা
যব মাটি সে সব মিল জায়গা।
গান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লালমামি বললেন, দক্ষিণের জানালা বন্ধ কর নবু, ভিজে যাচ্ছি।
নবুমামা বললেন, বাদশা ভাই কোথায়?
দু’দিন ধরে দেখা নেই। কোথায় কে জানে। যদি ভাল না লাগে গানটা দে। ঘুম আসছে যে আবার। ও নবু, তোর ঘুম পায় না?
শুনতে শুনতে ঘুমে চোখ জড়িয়ে এল। ঘুমুতে ইচ্ছে করছিল। শুয়ে শুয়ে গান শুনতে কি ভালোই না লাগে! ক্রমে ক্রমে ঝড়ের মত বাতাসের বেগ হল। বাড়ির লম্বা থামে বাতাসের শো শো শব্দ উঠতে লাগল। ধরাম ধরাম শব্দ করে দরজা নড়তে লাগল। উঠে দাঁড়িয়েছি হ্যাঁরিকেন জ্বালাব বলে, ওমনি সফুরা খালা ডাকলেন,
রঞ্জু, ও রঞ্জু!
দরজা খুলে দেখি সারা গায়ে চাদর জড়িয়ে সফুরা খালা বৃষ্টির ছাঁটে ভিজছেন। মৃদু কণ্ঠে বললেন, এদিকে গান হচ্ছে না-কি রঞ্জু?
হ্যাঁ, নবুমামা কলের গান বাজাচ্ছিলেন। কলেব গান এনেছেন নবুমামা।
নবু, কোথায়?
লালমামি আর নকুমামা গান বাজাচ্ছেন।
সফুরা খালা আরো একটু এগিয়ে এসে বললেন, কই গান শুনছি না তো?
আমরা দুজন কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। সফর খালা অস্পষ্ট স্বরে বললেন, রঞ্জু, আমার ভীষণ ভয় লাগছে!
সেই অপূর্ব বৃষ্টিস্নাত রাতে যে ভয় করবার মতু কিছু-একটা লুকিয়ে ছিল তা আমি বুঝতে পারি নি। সফুব খালা শীতে কঁপিছিলেন, তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না, তবু শুধুমাত্র তার কথা শুনেই ধারণা হল, কোথাও নিশ্চযই ভয় লুকিয়ে আছে।
সফুরা খালা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দ্রুত চলে গেলেন যেন কোন হিংস্র জন্তু তাকে তাড়া কবছে। মাতালের মত বেসামাল পদক্ষেপ। আমি এসে গুয়ে পড়লাম।
ঘুম ভাঙল অনেক বেলায়। মেঘ কেটে গেছে, রোদ উঠছে ঝকঝকে। জানোলা দিয়ে বাইরে তাকালেই মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকব কি-না ভাবছি, তখন নবুমামা এসে ডাকলেন, আয়, মাছ ধরতে যাই। নতুন পানিতে মেলা মাছ এসেছে।
ছিপ, কানিজাল ইত্যাদি সরঞ্জাম নিয়ে নৌকা করে চললাম দুজনে হলদাপোতা। কিন্তু নবুমামার মাছ মারার মন ছিল না। অপ্রাসঙ্গিক নানা কথা বলতে লাগল। দুপুর পর্যন্ত আমরা ইতস্তত ঘুরে বেড়ালাম। নবুমামার ভাবভঙ্গি আমার কাছে কেমন কেমন লাগল। তিনি যেন বিশেষ কোন কারণে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিয়ের কথা বললে কিশোরী মেয়েরা যেমন পালিয়ে গিয়ে লজ্জায় লাল হয অনেকটা সে বকম। নবুমামা বললেন, রঞ্জু, আমি আর পড়াশুনা করব না।
কেন?
ভাল লাগে না।
কি করবেন তবে?
ব্যবসা করব। দেশে দেশে ঘুরে বেড়াব।
নানাজান মানবে না।
আমি কারো ধার ধারি না-কি?
বলতে বলতে নবুমামা ঈষৎ হাসলেন। দুপুরে খাওয়ার জন্যে চিড়া আর নারিকেল আনা হয়েছিল। তা-ই খাওয়া হল। হালদাপোতা থেকে আমরা আরো উত্তরে সরে গেলাম।
আমার আর ভাল লাগছিল না, রোদে গা তেতে উঠেছে। ইচ্ছে হচ্ছে ফিরে যাই কিন্তু নবুমামা বার বার বলছেন, একটা বড় মাছ ধরি আগে।
সন্ধার আগে আগে প্রকাণ্ড একটা কাতলা মাছ ধরা পড়ল। সুগঠিত দেহে কালচে আঁশ বেলাশেষের রোদে ঝকমক করছে। নৌকার পাটাতনে মাছটা ধড়ফড় করতে লাগল। দুজনেই মহাখুশি। নবুমামা খুব যত্নে বড়শি খুলে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি বললাম, চলুন ফিরে চলি।
চল।
ভাটার টানে নৌকা ভেসে চলেছে। হঠাৎ করে নবুমামার ভাবান্তর হল। আমার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বললেন, মাছটা ছেড়ে দেই রঞ্জু?
কেন মামা!
না, ছেড়ে দি।
বলেই মাছটা জলে ফেললেন। আমি চুপ করে রইলাম। নবুমামা বললেন, একবার আমি একটা পাখি ধরেছিলাম। টিয়া পাখি। তারপর কি মনে করে ছেড়ে দিয়েছি। আমার খুব লাভ হয়েছিল।
কি লাভ?
হয়েছিল। আজকে মাছটা ছেড়ে দিলাম! দেখিস, মাছটা দোয়া করবে আমার জন্যে।
নবুমামা পাটাতনে শুয়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন।
বাড়ি এসে হুলস্কুল কাণ্ড। লালমামির সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়া হয়েছে সফুরা খালার। লালমামি টেনে সফুরা খালার একগোছা চুল তুলে ফেলেছেন, গাল আঁচড়ে দিয়েছেন। সফুরা খালা বিষম দৃষ্টিতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। লালমামি তার দরজা বন্ধ করে রেখেছেন। কারে সঙ্গে কথাবার্তা নেই। বাদশা মামা আধময়লা একটা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। মাঝে মাঝে বলছেন, সবাই যদি এলাচির সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে বেচারি কি কববে? কেউ দেখতে পারে না। ছোট নানীজান শুনে শুনে বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। এবার ধমকে দিলেন, যা তুই, খামাখা ঘ্যান ঘ্যান। ভাল্লাগে না।
বাদশা মামা উঠানে গিয়ে বসে রইলেন। বোকাব মত তাকাতে লাগলেন। এদিক-সেদিক। নবুমামাকে দেখে বললেন, দেখলি নবু? সফুরা কি ঝগড়া করল। এলাচির সারাদিন খাওয়া নাই।
রাতের খাওয়া শেষ হতে অনেক রাত হল। রান্না হতে দেরি হয়েছে। সংসার যাত্রা কিছু পরিমাণে বিপর্যস্ত। খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমুতে এসে দেখি, সফুরা খালা বসে আছেন আমাদের ঘরে। সফুরা খালা বললেন, তোমাদের জন্যে বাইরের বাংলাঘরে বিছানা হয়েছে। এ ঘরে আমি থাকব। তাকিয়ে দেখি পরিপাটি করে ঘর সাজানো। আমার আর নবুমামার ব্যবহারিক জিনিসপত্র কিছুই নেই। নবুমামা বললেন, তুই থাকবি কেন এখানে? তোর নিজের ঘর কি হল?
আমার ঘরে পানি পড়ে, বিছানা ভিজে যায়।
নবুমামা কিছুক্ষণ উদ্ধত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তারপর হন হন করে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। সফুরা খালা বললেন, রঞ্জু, তুমি নবুকে চোখে চোখে রাখবে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বাদশা মামার সঙ্গে দেখা। বাদশা মামা বললেন, রঞ্জু, এলাচি ভাত খেয়েছে কিনা জানিস?
জানি না।
মোহরের মা বলল, খেয়েছে। তুই একটু খোঁজ নিয়ে আয়।
আপনি নিজে যান না মামা।
আচ্ছা, আচ্ছা আমি নিজেই যাই।
লালমামি সেদিন না খেয়ে ছিলেন। রাতেও খেলেন না, দুপুরেও ভাত নিয়ে গিয়ে মোহরের মা ফিরে এল। সফুরা খালা অনেক অনুনয়-বিনয় করলেন। কিছু লাভ হল না। শেষ পর্যন্ত নানাজান আসলেন। বিরক্ত ও দুঃখিত কণ্ঠে বললেন, এ সব কি বউ?
লালমামি কথা বললেন না। নানাজান বললেন,
খাও খাও, ভাত খাও।
না, খাব না।
সমস্ত দিন কেটে গেল। সফুরা খালা কাঁদতে লাগলেন। কি বিশ্ৰী অবস্থা! বাদশা মামা নৌকা করে গিয়েছে শ্ৰীপুরে। লালমামির মাকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন একেবারে।
কানাবিবি বার বার বলে, বউ-এর কোনো খারাপ বাতাস লেগেছে, না হলে এমন হয়। মুকন্দ ওঝাকে খবর দেও না একবার।
লালমামির মা খবর পেয়েই এসে পড়লেন। লালমামি বলল, না আমি কিছুতেই খাব না। এ বাড়িতে কিছু খাব না। আমি। নানাজান বললেন, আচ্ছা, মেয়েকে না হয় নিয়েই যান। কদিন থেকে সুস্থ হয়ে আসুক।
ধরাধরি করে লালমামিকে নৌকায় তোলা হল। নৌকার পাটাতনে বাদশা মামা তার সুটকেস নিয়ে আগে থেকেই বসে আছেন। লালমামি বাদশা মামাকে দেখেই জ্বলে উঠলেন।
ও গেলে আমি যাব না। আল্লাহর কসম আমি যাব না।
বাদশা মামা চুপচাপ নেমে পড়ে দাঁড়িয়ে বোকার মত সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। যেন কিছুই হয়নি। তার কাণ্ড দেখে আমার চোখে পানি এসে গেল।
নবুমামার বিয়ের জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন সবাই। মেয়ে তো আগেই ঠিক করা ছিল। এবার কথাবার্তা এগুতে লাগল। নানাজান অনেক রকম মিষ্টি, হলুদ রঙের শাড়ি ও কানের দুল নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়ে দেখতে গেলেন। সঙ্গে গেলেন হেড মাস্টার সাহেব, আজিজ আলী সাহেব। আমিও গেলাম তাদের সঙ্গে। কি মিষ্টি মেয়ে শ্যামলা রঙ, বড় বড় চোখ। এক নজর দেখলেই মন ভরে ওঠে। দেখে আমার বড় ভাল লাগল। পৌষ মাসের মাঝামাঝি দিন ফেলে নানাজান উঠে এলেন।
বাড়িতে একটি চাপা আনন্দের স্রোত বইতে লাগল। সবচেয়ে খুশি সফুরা খালা। হাসি-হাসি মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সবার সঙ্গে বিয়ে নিয়ে গল্প করছেন। নবুমামার কিন্তু ভাবান্তর নেই। কি হচ্ছে না হচ্ছে তা নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। মাছ ধরতে যান। কোথাও যাত্ৰা টাত্রার খবর পেলে যাত্রা শুনতে যান।
গ্রামের মাঠে ফুটবল নেমে গেছে। সারা বিকাল কাটান ফুটবল খেলে। সেনটার ফরোয়ার্ডে তিনি দাঁড়ালে প্রতিপক্ষ তটস্থ হয়ে থাকে। শিল্ডের অনেক খেলা শুরু হয়ে গেছে। গ্রামের টিম খুব শক্ত। ফাইন্যালে উঠে যাবে, সন্দেহ নেই। নবুমামা প্ৰাণপণে খেলেন। মরণপণ খেলা। বল নিয়ে দৌড়ে যাবার সময় তার মাথার লম্বাচুল বাতাসে থারথারিয়ে কাপে। মাঠের বাইরে বসে বসে মুগ্ধ নয়নে আমি তাই দেখি। রাতের বেলা গরম পানি করে আনি, নবুমামা গরম পানিতে পা ডুবিয়ে অন্যমনস্কভাবে নানা গল্প করেন। লালমামির প্রসঙ্গে কোনো আলাপ হয় না। তিনি সেই যে গিয়েছিলেন আর ফেরার নাম নেই। বাদশা মামা প্রতি হাটবারে নৌকা নিয়ে চলে যান। আবার সেদিনই ফিরে আসেন। লালমামির ঘরেই বাকি সময়টা কাটে তার। আমি বুঝতে পারি, কোথায়ও সুর কেটে গিয়েছে। ভাল লাগে না। কবে লিলির চিঠি আসবে, কবে আমি চলে যেতে পারব, তাই ভাবি। তখন আমি অনেক স্বপ্ন দেখতে শিখেছি। পরগাছা হয়ে বেঁচে থাকতে ঘেন্না বোধ হচ্ছে অথচ বেরিয়ে আসতে পারছি না। বড় নানীজান অনেক সম্পত্তি না-কি আমাকে আর লিলিকে দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তাতে আমার অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয়নি।
তাছাড়া সে সময় আমি প্রেমেও পড়েছিলাম। অচিনপুরের এই কাহিনীতে সে প্রেমের উল্লেখ না করলেও চলে, কারণ তার ভূমিকা নেই এখানে। তবে প্রচণ্ড পরিবর্তন হচ্ছিল আমার মধ্যে এইটুকু বলা আবশ্যক।
নবুমামার স্কুল ফাইন্যালের রেজাল্ট হল তখন। খুবই ভাল রেজাল্ট। ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেলেন। কলেজে ভর্তি হবার জন্যে টাকা-পয়সা নিয়ে নবুমামা রওনা হলেন। নানাজানের ইচ্ছা ছিল নবুমামা যেন আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু নবুমামার ইচ্ছে প্রেসিডেন্সি কলেজ।
নবুমামার বিয়ের তারিখ ঠিকই থাকল। নবুমামা নিজেও একদিন মেয়ে দেখে এলেন। সফুরা খালা যখন বললেন, মেয়ে পছন্দ হয়েছে? নবুমামা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়েছে।
বারোই ভাদ্র তারিখে নবুমামা চলে গেলেন। আর তেরোই ভদ্র বাদশা মামা শ্ৰীপুর থেকে আধ-পাগল হয়ে ফিরে এলেন। আমি ভাসা ভাসা ভাবে শুনলাম, লালমামি শ্বশুরবাড়ি ফিরে যাবার নাম করে নবুমামার সঙ্গে চলে গিয়েছেন।
কেউ যেন জানতে না পারে সেই জন্যে বাদশা মামাকে ঘরে বন্ধ করে রাখা হল। তার ঠিক নেই, কখন কাকে কি বলে বসেন। ছোট নানিজানের ফিটের ব্যারাম হয়ে গেল। সফুরা খালাকে দেখে কোন পরিবর্তন নজরে পড়ে না। শুধু তার চোখে কালি পড়েছে। মুখ শুকিয়ে তাকে দেখায় বাচ্চা ছেলের মত।
নানাজান সেই বৎসরেই হজ করতে গেলেন; যাওয়ার আগে সব সম্পত্তি বিলি বন্দোবস্ত হল। বাদশা মামাকে সব লিখে-পড়ে দিয়ে গেলেন।
একটি প্রচণ্ড প্রাচীন বটগাছ যেন চোখের সামনে শুকিয়ে উঠেছে। সবুজ পাতা ঝরে যাচ্ছে, কাণ্ড হয়েছে অশক্ত। আমি তাই দেখছি তাকিয়ে তাকিয়ে। শৈশবের যে অবুঝ ভালবাসায় নানাজানের বাড়িটিকে আমি ঘিরে রেখেছিলাম, সেই ভালবাসা করুণ নয়নে চেয়ে আছে আমার দিকে। কিন্তু আমি তো এখানের কেউ নই। একদিন চুপচাপ চলে যাব। কেউ জানতেও পারবে না রঞ্জু নামের আবেগপ্রবণ ছেলেটি কোথায় চলে গেল।
এ বাড়ির সব কিছুই বদলে গেছে। লাল ফেজটুপি পরা নানাজান সূর্য উঠার আগেই উঠোনের চেয়ারে এসে আর বসে না। “ফাবিয়ায়ে আলা রাব্বি কুমা তুকাজ্জিবান” ঘুম-ঘুম চোখে অর্ধ-জাগ্রত কানে কতবার শুনেছি এই সুর। এখন সকালটা বড়ো চুপচাপ।
ভোরের আলোয় মনের সব গ্লানি কেটে যায়। আমি চাই এ বাড়ির সবার মনের গ্লানি কেটে যাক। নবুমামা ফিরে এসে আগের মত জোছনা দেখে উল্লাসে চিৎকার করুক। কি জোছনা! খেতে ইচ্ছে করে। সফুরা খালা ঠিক আগের মত লাঠি হাতে পাখি উড়ে গেল বলে এ সংসারের যাবতীয় দুঃখ-কষ্ট উড়িয়ে দিক। বাদশা মামা তার সাজ-পোশাক পরে হিরণ্য রাজার পাঠ করুক। কিন্তু তা আর হবে না, তা হবার নয়। আমি সংসারের মন্থর স্রোতে গা এলিয়ে দিলাম। কারো সঙ্গেই আজ আমার যোগ নেই। দিন কেটে যেতে লাগল।
চলবে,,,,,,,,,,,,,
No comments