Ads

হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস "অচিনপুর" তৃত্বীয়-পর্ব । @মিঃ মধু

 হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস  "অচিনপুর" তৃত্বীয়-পর্ব ।  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা
                                                                                                                                  "অচিনপুর" দ্বিতীয়-পর্ব 

---অচিনপুর---
(তৃত্বীয়-পর্ব)

নানাজান বললেন, ঠিকানা নিয়ে কী করবি?
চিঠি লিখব।
এতদিন পর চিঠি লেখার কথা মনে পড়ল?
আমি চুপ করে রইলাম। নানাজান একটু কেশে বললেন,
শরীরের হাল কেমন? জ্বর আছে?
জি, না।
নবু তোর কাছে চিঠি-ফিঠি লেখে।
জি লেখে।
পূজার বন্ধে বাড়ি আসবে বলে চিঠি লিখেছে আমার কাছে। বলতে বলতে নানাজান হঠাৎ কথা থামিয়ে বলেন,
লিলিরা আগে যেখানে থাকত এখন সেখানে নাই। নতুন ঠিকানা তো আমার জানা নাই। আচ্ছা, আমি খোঁজ নিয়ে বলব।
লিলি আপনার কাছে চিঠি লেখে নানাজান?
নানাজান একটু ইতস্তত করে বললেন, কম লেখে।
 
আশ্বিনের গোড়াতেই নবুমামা এসে পড়লেন।
তাকে দেখে আমার চোখে পলক পড়ে না। লম্বায় বেড়েছেন, স্বাস্থ্য ভাল হয়েছে। ঠোঁটের ওপর হালকা নীল গোঁফের রেখা। নবুমামা আমাকে দেখেই হৈ হৈ করে উঠলেন, তোর এ কি হাল রঞ্জু!
অসুখ করেছিল। আমার। আপনাকে আর চেনা যায় না মামা।
স্বাস্থ্য দেখেছিস? দেখ, হাতের মাসল টিপে দেখ।
মাসল টিপে দেখার দরকার পড়ে না। নবুমামার স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য দেখে ঈৰ্ষা হয় আমার। লালমামি তো নবুমামাকে চিনতেই পারেন না, কে এসেছে ভেবে থতমত খেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওমনি নবুমামা খপ করে তার হাত চেপে ধরলেন। মামি বললেন,
নবু নাকি? তুমি তো বদলে গেছ।
মামি নবুমামাকে আজ প্রথম তুমি করে বললেন। নবুমামা হেসেই কূল পান না। হাসি থামিয়ে কোনমতে বললেন,
ভাবী, তুমি আগের মতই আছ। না, আগের মত নয়, আগের চেয়ে সুন্দর।
অনেক দিন পর নবুমামাকে দেখে কি যে ভাল লাগল! তাছাড়া, মামা এত বেশি বদলে গেছেন। কি করে সেও এক বিস্ময়। ছোটবেলায় দুজনকে তো একই রকম দেখাত। আমি পরম বিস্ময় নিয়ে নবুমামার পিছু পিছু ফিরতে লাগলাম। নবুমামার গল্প আব্বা ফুরোয় না। স্কুলের গল্প, স্কুলের বন্ধুদের গল্প। রাজশাহীর গল্প। এর মধ্যে রাজশাহী থেকে নাটোর রাজবাড়িতে গিয়েছিলেন তার গল্প। আমি শুনি আর অবাক হই।
নবুমামা ক্লান্ত হয়ে এসেছিলেন। দুপুবে খেয়ে-দোয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। আমিও বেশ শুয়ে আছি কখন নবুমামা জাগবেন। সেই আশায়। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। ছোট নানিজান এসে ডেকে তুললেন। দুজনে চলে গেলাম। লালমামির ঘরে। মামির প্রতি নবুমামার শৈশবেব যে টান ছিল তা দেখলাম। এতদিনের অদর্শনে এতটুকু কমেনি, ববং বেড়েছে।
লাল মামি বললেন, নবু, আমার ভীষণ মাথা ধরেছে, পরে গল্প কবব তোমাব সাথে। নবুমামা হো হো করে হাসেন।
না, গল্প এখনি করতে হবে। আর আগের মত তুই করে ডাকতে হবে।
এই বলে নবুমামা দাবজায় খিল এঁটে দিলেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম, নবুমামা রহস্যময ভঙ্গিতে তার প্যান্টের পকেটে হাত দিচ্ছেন,
তোমার জন্যে কি এনেছি, দেখ ভাবী।
বল তো দেখি কি? আন্দাজ কর।
লালমামি ভ্র কুঞ্চিত করলেন। নবুমামা বললেন,
ছোটবেলায় আমাদের সিগারেট খাইয়েছিলে। আজ আমি সিগারেট নিয়ে এসেছি। আজকে আবার খেতে হবে।
তুমি কি এর মধ্যেই সিগারেট ধরেছ নাকি?
না, ধরিনি। তোমার জন্য এনেছি।
বলেই নবুমামা নিজে একটা সিগারেট ধরিয়ে লালমামির দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলেন। লালমামি বললেন,
আমি সিগারেট খাব না।
খেতেই হবে।
নবুমামা জোর করে মামির মুখে সিগারেট গুঁজে দিলেন। থু ধু করে ফেলে দিয়ে মামি শুকনো গলায় বললেন,
তুমি বড়ো বেয়াড়া হয়ে গেছ নবু।
নবুমামা ভ্রক্ষেপ করলেন না। কায়দা করে সিগারেটের ধোয়া ছাড়তে লাগলেন। এক সময় বললেন,
ভাবী, তোমার কাছে আমি এত চিঠি লিখলাম, জবাব দাওনি কেন?
একটা তো দিয়েছি।
না, এবার থেকে সব চিঠির জবাব দিতে হবে।
এই বলে নবুমামা বেরিয়ে এলেন। বললেন, রঞ্জু, চল মাঠে বেড়াই। খুব বাতাস দিচ্ছে, মাঠে হাঁটলে খিদে হবে।
মাঠে সে রাতে প্রচুর জোছনা হয়েছে। চকচক করছে চারদিক। ঠাণ্ডা একটা বাতাস বইছে। নবুমামা চেঁচিয়ে বলল, কি জোছনা! খেতে ইচ্ছে হয়। মনে হয় কপি কপি করে খেয়ে ফেলি। নবুমামা মুখ হা করে খাবার ভঙ্গি করতে লাগল। বিস্মিত হয়ে আমি তার আনন্দ দেখলাম।
অনেক রাতে বাড়ি ফিরে দেখি বাদশা মামা জলচৌকিতে চুপচাপ বসে আছেন। নবুমামাকে দেখে নির্জীব কণ্ঠে শুধালেন,
কখন এসেছিস?
সকালে। তুমি কোথায় ছিলে?
বাদশা মামা বিড়বিড় করে কি বললেন, বোঝা গেল না। নবুমামা বললেন, তোমার কি হয়েছে?
বাদশা মামা এর উত্তরেও বিড়বিড় করলেন।
ভাত খেতে খেতে নবুমামা বললেন, বাদশা ভাইয়ের কি হয়েছে?
নানীজান বললেন, জাদু করেছে তাকে।
কে জাদু করেছে?
কে আবার; বউ।
নবুমামা রেগে গিয়ে বলল, কি সব সময় বাজে কথা বলেন।
নানীজান বললেন, কি যে গুণের বউ, তা কি আর এতদিনে জানতে বাকি আছে আমার? বাদশার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না।
লালমামি কখন যে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন জানতে পারিনি। ঠাণ্ডা গলায় বললেন, কে যাদু করেছে, মা?
নানীজান বললেন, বউ, তুমি চোখ রাঙিয়ে কথা বল কার সঙ্গে?
আমি চোখ রাঙিয়েছি?
তুমি কার ওপর গরম দেখাও বউ, রূপের দেমাগে তো পা মাটিতে পড়ে না। এদিকে আত্মীয়-স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারি না আমি। বাঁজা মেয়েমানুষ বলে সারা দুনিয়ার লোকে তোমাকে ডাকে।
নবুমামা বললেন, মা, আপনি চুপ করেন।
কোন চুপ করব? কাকে ডরাই আমি? বাদশাকে আজ বললে কাল সে তিন তালাক দেয়।
লালমামি বললেন, তাই বলেন না কেন? ঐ তো বসে আছে চৌকিতে। যান, গিয়ে বলেন।
নবুমামা আর আমি দোতলায় উঠে দেখি মামি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন বারান্দায়। আমাদের দেখে উঁচু গলায় বললেন,
নবু, তুমি কালকে আমাকে বাবার বাড়িতে রেখে আসবে?
নবুমামা চুপ করে রইলেন।
নবুমামা এক মাস রইলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি অনেক গল্পের বই নিয়ে এসেছিলেন, প্রতিদিন সেগুলি পড়া হত। লোহারামের কেচ্ছা বলে একটি বই ছিল। এমন হাসির! নবুমামা পড়তেন, আমি আর লালমামি শুনে হেসে গড়াগড়ি। ছোট নানীজান এক একদিন রেগে ভূত হতেন।
আস্তে হাসতে পার না বউ? তোমার শ্বশুর শুনলে কি হবে?
মোহরের মা আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলত–
যত হাসি তত কান্না

কহে গেল রাম সন্না।
নবুমামা শুনতে পেলে বলতেন, মোহরের মা, তোমার রাম সন্নাকে এই বইটা একটু পড়তে দিও। দেখি ব্যাটা হাসে কি কাঁদে।
একদিন হাসির শব্দ শুনে লাজুক পায়ে সফুরা খালা এসে হাজির। দরজার ওপাশ থেকে ফিকফিক করে বলছে,
ভাবী, তোমরা কি নিয়ে হাসছ?
গল্প শুনে হাসছি। হাসির গল্প।
সফুরা খালা ভেতরে এসে দাঁড়িয়ে মিটমিট হাসি হাসতে লাগলেন। যেন আমাদের কোনো গোপন অভিসন্ধি টের পেয়ে গিয়েছেন। তারপর আগের মত ফিকফিক গলায় বললেন,
হাসির গল্প আমার ভাল লাগে না।
তবু তিনি অনেক্ষণ পর্যন্ত বসে বসে নবুমামার গল্প পড়া শুনলেন। তারপর বললেন, চল না, সবাই মিলে দীঘির ঘাট থেকে বেড়িয়ে আসি। এখন তো আর লোকজন নেই।
সেদিন থেকে আমাদের রুটিন হল, গল্প-টল্প পড়ার পর দীঘির ঘাটে বেড়াতে যাওয়া। বেড়াতে বেড়াতে একদিন নবুমামার উল্লাসের কোনো সীমা থাকত না। স্কুল থেকে শিখে আসা একটা হিন্দি গান বেসুরো গলায় ধরে বসতেন। প্রথম লাইনটি বোধ হয় এরকম ছিল
“মাটি মে পৌরণ

মাটি মে শ্রাবণ

মাটি মে তেন বন যায়গা।”
পাখির ডানায় ভর করে সময় কাটতে লাগল। অবশ্যি বেড়াতে এসে মাঝে মধ্যে লালমামির ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। সেগুলি ঘটত তখনি যখন মামি দেখতে পেতেন বাদশা মামা ঘাটের উল্টোদিকে চুপচাপ বসে আছেন। দেখে মনে হয়, যেন মানুষ নয়, উইয়ের টিবি। এতটুকু নড়াচড়াও নেই।
দেখতে দেখতে নবুমামার ছুটির দিন ফুরিয়ে গেল। আমার মনে হতে লাগল, একা একা আমার থাকতে হলে আমি আর বঁচিব না। যতই যাওয়ার দিন এগিয়ে আসে ততই আমার কষ্ট বাড়তে থাকে। যাবার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যাবেলা ভারি মন নিয়ে লালমামির ঘরে বসে আছি। নবুমামাও কথা বলছেন না। এমন সময় নিচে থেকে কানাবিবি ডাকল, ও এলাচি বেগম! ও এলাচি বেগম!
লালমামি বললেন, আসছি, কেন ডাকে দেখে না।
নবু মামা বললেন–তোমার নাম এলাচি কেমন ভাবী?
আমার মুখে সব সময়-এলাচির গন্ধ থাকে, এই জন্যেই এলাচি নাম।
নবু মামা এগিয়ে এসেছেন, আগে তো কোনোদিন বলনি–শুঁকে দেখতাম! দেখি ভাবী, মাথাটা একটু নিচু করত।
কি পাগলামি কর নবু।
বলার আগেই নবু মামা লালমামির মাথা ঝাপটে ধরেছে এবং হৈ হৈ করে উঠেছে। আরে সত্যি তাই। এলাচির গন্ধ।
ছোট নানীজান ঢুকলেন এ সময়, শুকনো গলায় বললেন, ও বউ, তোমাকে এক ঘণ্টা ধরে ডাকছে কানাবিবি। কানে শুনতে-টুনতে পাও তো?
লালমামি বললেন, কি জন্যে ডাকছে?
সে যে তোমাকে গলায় আর কোমরে বাঁধবার জন্যে তাবিজ দিয়েছিল, সেগুলি কি করেছ?
ফেলে দিয়েছি।
কোন ফেলে দিয়েছ?
তাবিজ দিলে কি হবে?
নানীজান রেগে আগুন হয়ে বললেন, কি, অত বড়ো সাহস তোমার বউ? আল্লার কোরআন কালামকে অবিশ্বাস। রোজা নাই, নামায নাই! বেহায়া বেপর্দা মেয়ে!
নবুমামা বললেন, মা, আপনি চুপ করেন।
না, চুপ করব কেন? বউ শেষ কথা আমার, তাবিজ দিবা কি-না কও।
লালমামি বললেন, আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেন। সে যদি বলে তাবিজ দিলেই আমার ছেলেমেয়ে হবে, তাহলে দিব।
এমন সময় নিচে হৈচৈ শুনা গেল। আমি আর নবুমামা দৌড়ে গিয়ে দেখি, রহমত মিয়া শিকল খুলে কিভাবে যেন বেরিয়ে পড়েছে। হাতে শিকল নাচাচ্ছে, আর বলছে কাঁচা খাইয়া ফেলামু! কাঁচা খাইয়া ফেলামু!
লোকজন ঘিরে ফেলেছে তাকে। কাছে যেতে সাহস পাচ্ছে না। দু’একজন লম্বা বাঁশ বাগিয়ে ধরে আছে। নানাজান বললেন,
কেউ ওরে মারবে না, খবরদার। সাবধানে ধর।
বহু কসরত করতে হল ধরতে গিয়ে। শিকলের বাড়ি খেয়ে হারিস সর্দার তো প্ৰায় মরোমরো। নানাজান বললেন, যাও, নৌকায় করে পাগল হারামজাদাটাকে এক্ষুণি নন্দিপুরের বাজারে ছেড়ে দিয়ে আসো! এঁটো কাঁটা খেয়ে বেশ বেঁচে থাকবে।
ঘাটে নৌকা তৈরি ছিল। বহু উৎসাহী সহযাত্রী তৈরি হয়ে পড়ল। একটি জলজ্যান্ত পাগলকে অন্যগ্রামের বাজারে ছেড়ে আসা এ্যাডভেঞ্চারের মত।
পাগল তো কিছুতেই নৌকায় উঠবে না। চোঁচামেচি চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। কিন্তু নৌকায় উঠেই তার ভাবান্তর হল। হাত ডুবিয়ে দিল নদীর পানিতে, তারপর খুশিতে হেসে ফেলল।
আহা! পাগলটার কারবার দেখে বড়ো মায়া লাগে রে।
তাকিয়ে দেখি, ঘাটের উপর বসে থেকে বাদশা মামা আফসোস করছেন। তার চোখ স্নেহ ও মমতায় চক চক করছে।
পরবর্তী দু’দিন বাড়ির আবহাওয়া অত্যন্ত উত্তপ্ত রইল। নবু মামা যে সকালে চলে যাবেন সে সকালে লালমামির সঙ্গে কানাবিবির একটা ছোটখাটো সংঘর্ষ হয়ে গেল। ঘুম ভেঙেই শুনি লালমামী বলেছেন–
এ কানাবিবির কাজ। কানাবিবি, তোমার এমন সাহস।
কানাবিবি বলছে–
বাড়ির বউ মানুষ কেমন গলায় কথা কয় গো।
বিষয় আর কিছু নয়। লালমামি ঘুমোতে গিয়ে দেখেছেন, তার বালিশের নিচে শাড়ির পাড়ের টুকরো, মাথার চুল, একখণ্ড ছোট হাড়–এই জাতীয় জিনিস সুতো দিয়ে বেঁধে রেখে দেয়া। বশীকরণের জিনিসপত্র হয়ত। সেই থেকেই এ বিপত্তি।
নবুমামাকে স্টেশনে দিয়ে আসতে আমি সঙ্গে চলেছি। রাত দুটোয় ট্রেন। সন্ধ্যাবেলা খেয়েদেয়ে রওনা হয়েছি। হ্যাঁরিকেন দুলিয়ে একটি কামলা যাচ্ছে আগে আগে। ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে হুহু করে। নবুমামা আর আমি গল্প করতে করতে যাচ্ছি। হঠাৎ মামা বললেন,
ও তোকে বলা হয়নি, লিলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। শান্তাহার স্টেশনে। প্লাটফরমে বসেছিল, আমি তাকে চিনতে পারিনি। হঠাৎ ডাকল,
নবুমামা, না?
নবুমামা কিছুক্ষণ থেকে বললেন, খুব গরিব হয়ে গেছে। রোগা হয়েছে খুব। ময়লা কাপড়চোপড়। এমন খারাপ লাগল দেখে।
লিলির বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি?
না, লিলি বলল, আমাকে দেখে লজ্জা পেয়ে নাকি লুকিয়ে আছে কোথায়।
আর কিছু বলেনি?
তোর কথা জিজ্ঞেস করল। তার অবস্থা একটু ভালো হলেই তোকে নাকি তার কাছে নিয়ে যাব।
নবুমামা বললেন, তোর মন খারাপ হয়েছে?
হ্যাঁ।
আমারো হয়েছে। বিয়ের পর যখন লিলি শ্বশুরবাড়ি গেল, মনে আছে, রঞ্জু?
আছে।
ট্রেনে উঠে কি কাঁদাটাই-না কাঁদল।
নবুমামা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন।


সেবার আমি খুব অর্থকষ্টে পড়লাম।
স্কুলের বেতন দিতে হয়। মাঝে-মধ্যে চাঁদা দিতে হয়। আগে নবুমামা যখন দিতেন সে সঙ্গে আমারটাও দিয়ে দিতেন। এখন আমি একলা পড়েছি। নিজ থেকে কারো কাছে কিছু চাইতে পারি না। পোশাকের বেলায়ও তাই। নবুমামার কাপড়-জামা বরাবর পরে এসেছি। লিলিও প্রায়ই বানিয়ে দিয়েছে। অসুবিধে হয়নি কিছু। এখন অসুবিধে হতে লাগল। কি করব ভেবে পাই না। বাদশা মামার কাছে কিছু চাইতে লজ্জা করে। আমি খুব মুশকিলে পড়ে গেলাম। নিজেকে অবাঞ্ছিত ভাবা খুব কষ্ট ও লজ্জার ব্যাপার। আমার ভারি কষ্ট হতে লাগল। খুব ইচ্ছে হতে লাগল লিলির কাছে চলে যাই। কিন্তু তার কাছে চিঠি লিখে জবাব পাই না। পুরোনো জায়গা ছেড়ে তারা নতুন যেখানে গিয়েছে, তার ঠিকানাও জানায়নি কাউকে।
তাছাড়া নানাজানের সংসারেও নানারকম অশান্তি শুরু হয়েছে। তাঁর জন্মশক্রি হালিম শেখ জমি নিয়ে মামলা শুরু করেছে। টাকা খরচ হচ্ছে জলের মত। বৃদ্ধ বয়সে নানাজানকে কোর্ট-কাঁচারিতে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে। বাদশা মামাকে দিয়ে তো কোন কাজ করাবার উপায় নেই। তিনি জড় পদার্থের মত হয়ে গিয়েছেন। সুফি সাহেবের বাড়ি থেকে ফিরবার পর বেশ কিছুদিন ধর্ম-কর্ম নিয়ে ছিলেন। লোকে ভালই বলেছে। এখন সেসব ছেড়েছেন। নেশা-ভাঙও নাকি করেন আজকাল।
সফুরা খালাকে নিয়েও অনেক রকম অশান্তি হচ্ছে। তখন তিনি দেখতে দেখতে বড় হয়ে উঠেছিলেন। তার বিয়ের কথাবার্তাও হচ্ছে। একবার সব ঠিকঠাক হয়ে গেল। ছেলের বাবা মেয়ে দেখে মহাখুশি। এমন ভাল স্বভাবের মেয়ে সে নাকি তার সমস্ত জীবনে দেখেনি। কিন্তু বিয়ে হল না। সফুরা খালাকে নিয়ে নানারকম রটনা। তার না-কি মাথা খারাপ। রাতে-বিরেতে মেয়ে না-কি পুকুরঘাটে হেঁটে বেড়ায়। একবার কোনো মেয়ে সম্পর্কে এ জাতীয় কথা ছড়িয়ে পড়াটা খুব খারাপ লক্ষণ। এ নিয়ে ঘরেও অশান্তির শেষ নেই। নানিজান বিনিয়ে-বিনিয়ে গানের মত সুরে কাঁদেন। মাঝে মাঝে আপন মনে বলেন, আমার নসীব, বিয়ে করালাম ছেলে, বউটা বাঁজা–মেয়েটাও আধা-পাগলা।
কিন্তু যাকে নিয়ে এত অশান্তি সেই সফুরা খালা নির্বিকার। আমি একদিন সফুরা খালাকে জিজ্ঞেস করলাম, খালা, আপনি নাকি রাতে-বিরেতে একা একা ঘুরে বেড়ান?
খালা মৃদু গলায় বললেন, এক একা পুকুর ঘাটে বসে থাকতে এত ভাল লাগে!
তাকে নিয়ে চারিদিকে যে এত অশান্তি সেদিকে কিছুমাত্র খেয়াল নেই। আছে আপন মনে। তার জন্যে আমার খুব কষ্ট হতে শুরু করল। খালাকে আমি তখন ভালবেসে ফেলেছি।
 
আসলে খালাকে আমি একটুও বুঝে উঠতে পারিনি। যাবতীয় দুর্বোধ্য বস্তুর জন্যে মানুষের স্বাভাবিক আকর্ষণ থাকে। সেই জন্যেই তার প্রতি আমার প্রবল ভালবাসা গড়ে উঠল। আমার ইচ্ছে হল, তার সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব গড়ে উঠুক।
কিন্তু তিনি নিজের চারদিকে একটি দেয়াল তুলে দিয়েছিলেন। এই দেয়াল ভেদ করে তার নৈকট্য লাভের উপায় নেই। নিজের সৃষ্টি জগতেই তিনি ডুবে আছেন। বাইরের প্রতি একটুও খেয়াল নেই। ইচ্ছে হল তো চলে গেলেন পুকুর পাড়ে। একা বেড়াতে গেলেন বাগানে।
এসব দেখে-শুনে কেন জানি না। আমার একটা ধারণা হয়েছিল, সফুরা খালা বড় রকমের দুঃখ পাবে জীবনে। এ রকম মনে করবার কোন কারণ ছিল না। কিন্তু আমার মনে হত, একেই হয়ত intuition বলে।
পরবর্তী জীবনে দেখেছি। আমার ধারণা অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। দুঃখ এসেছে এবং অত্যন্ত সহজভাবে জীবনের প্রাত্যহিক ঘটনার মত দুঃখকে তিনি গ্রহণ করেছেন। এই মেয়ের গল্প আমি অন্য কোথাও বলব। আজ শুধু হাসান আলীর কথাটাই বলি।
হাসান আলী বাজারে কিসের যে ঠিকাদারী করত। ছাব্বিশ-সাতাশ বছর বয়স। ভীষণ গরিব। নানাজানের কি রকম যেন আত্মীয়। থাকত নানাজানের বাংলাঘরে (বাড়ির বহির্মহলে অতিথি অভ্যাগতদের জন্যে নির্মিত ঘরকেই বাংলাঘর বলা হত)।
অত্যন্ত নিরীহ ধরনের ছেলে। যতক্ষণ ঘরে থাকত। ততক্ষণ বসে বসে হিসেবপত্র করত। আমরা সে সময় তার ঘরে হাজির হলে বিনা কারণে আঁৎকে উঠত। তারপরই সহজ হওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে চোখ লাল করে এক বিশ্রি কাণ্ড। প্রতি হাটবার দিন দেখতাম সে অল্প কিছু মিষ্টি কিনে এনেছে। মিষ্টি আনা হয়েছে নানাজানের বাড়ির মানুষদের জন্যেই কিন্তু দেওয়ার সাহস নেই। অনেক রাতে কাউকে ডেকে হয়ত ফিসফিস করে বলল, একটু মিষ্টি এনেছিলাম। বাড়ির প্রায় মানুষই তখন ঘুমে।
সফুরা খালা একদিন বললেন, ও রঞ্জু, হাসান আলী বলে একটা লোক নাকি থাকে বাইরের ঘরে। আমি বললাম, হ্যাঁ, আপনি জানলেন কি করে?
ও আল্লা, মজার ব্যাপার হয়েছে। পরশুদিন দিঘির পাড়ে একা একা গিয়েছি, দেখি কে একজন লোক চুপচাপ বসে আছে। আমি বললাম, কে ওখানে। লোকটা বলল, আমার নাম হাসান আলী, আমি আপনাদের বাংলা ঘরে থাকি। আমি তখন ভাবলাম, ফিরে যাই। লোকটা বলল, এত রাতে আপনি একা একা আসেন কেন? কত সাপ-খোপ আছে। আমি বললাম, আপনি তো আসছেন, আপনার সাপের ভয় নাই?
লোকটা তখন কি বললেন জান রঞ্জু?
না।
বলল, আপনি বড় ভাল মেয়ে এই বলেই হন হন করে চলে গেল। কি কাণ্ড দেখেছ?
এর কিছুদিন পরই শুনলাম হাসান আলী নানাজানের কাছে তার ছোট মেয়েটিকে বিয়ে করার প্রস্তাব করছে। নানাজান তো রেগেই আগুন। বাড়িতে হাসাহাসির ধুম পড়ে গেল। সফুরা খালা শুধু বলেন, আহা, বেচারা গরিব বলে কি সবাই এ রকম করবে। ছিঃ! লালমামি ওকথা শুনে বললেন, আমাদের সফুরার ভাতারকে নিয়ে কেউ তামাশা করবে না, খবরদার। সফুরা মনে কষ্ট পায়। নানীজান লালমামির কথা শুনে রেগে যান। চেঁচিয়ে বলেন, এ কি কথা বলার ঢং বউ!
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। নানাজান হাসান আলীকে এখানকার বাস উঠিয়ে চলে যেতে বললেন। শরৎকালের এক সকালে নৌকা করে হাসান আলী চলে গেল। দুটি ট্রাঙ্কের উপর বিবৰ্ণ সতরঞ্জিতে ঢাকা একটি বিছানা, তার পাশে মুখ নিচু করে বসা হাসান আলী।
সফুরা খালা এর পর থেকেই অস্থির হয়ে পড়লেন। মুখে শুধু এক বুলি, বিনা দোষে কষ্ট পেল লোকটা! নবুমামা অনেক পরে এ ঘটনা শুনে বলেছিলেন, আমি থাকলে দিতাম শালার ঘাড়ে গদাম করে এক ঘুসি। সফুরা খালা বিষণু কণ্ঠে বলছেন, ছিঃ নবু, ছিঃ!


অচিনপুরের গল্প লিখতে গভীর বিষাদে মন আচ্ছন্ন হয়ে আসছে। অনুভব করছি, সুখ এবং দুঃখ আসলে একই জিনিস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুখ বদলে গিয়ে দুঃখ হয়ে যায়। দুঃখ হয় সুখ। জীবনের প্রবল দুঃখ ও বেদনার ঘটনাগুলি মনে পড়লে আজ আমার ভাল লাগে। প্রাচীন সুখের স্মৃতিতে বুক বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়।
হাসনার কোলে তিন মাস বয়সের যে শিশুটি এ সংসারে প্রবেশ করেছিল তার ভূমিকা তো যুক্তিসঙ্গত কারণেই তৃতীয় পুরুষের ভূমিকা হবে। তার উপস্থিতি হবে ছায়ার মত। সরফরাজ খানের এই পরিবারটির সুখ-দুঃখ তাকে স্পর্শ করবে না। কিন্তু আমি তাদের জীবনের সঙ্গে কত ঘনিষ্ঠভাবেই না জড়িয়ে পড়লাম। বাদশা মামার মলিন চেহারা দেখলে আমার মন কাঁদে। সফুরা খালা যখন হেসে হেসে বলেন,
রঞ্জু, আমার খুব ইচ্ছে একদিন অনেক রাত্রে পুকুরে একা একা সাতার কেটে গোসল করি। পুকুর-ঘাটে তুমি আমার জন্যে একটুখানি দাঁড়াবে রঞ্জু? কেউ যেন জানতে না পারে।
তখন সফুরা খালার জন্যে আমার গাঢ় মমতা বোধ হয়। অথচ আমি নিশ্চিত জানি একদিন লিলির চিঠি আসবে। আমি এদের সবাইকে পেছনে ফেলে চলে যাব।
 
হালিম শেখের সঙ্গে পর পর দুটি মামলাতে নানাজানের হার হল। এতদিন যে জমিতে নানাজানের দখলিস্বত্ব ছিল, হালিম শেখের লোকজন লাল নিশান উঠিয়ে ঢোল আর কাসার ঘণ্টা বাজাতে বাজাতে সে জমির দখল নিল। গ্রামের লোকজনকে গরু জবাই করে খাওয়াল হালিম শেখ।
জমির পরিমাণ তেমন কিছু নয়। অর্থব্যয়ও হয়েছে সামান্য। নানাজানের মত লোকের কাছে সে টাকা কিছুই নয়। কিন্তু তিনি ভেঙে পড়লেন। রোজকার মত উঠোনে বসে কোরান পাঠ করতে বসেন না। নিজের ঘরে চুপচাপ বসে থাকেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের ভেতর স্বাস্থ্য ভেঙে গেল। খাওয়া কমে গেল। রাতে ঘুমুতে পারেন না। উঠোনে অনেক রাত পর্যন্ত চেয়ার পেতে বসে থাকেন। নানীজান মাথায় হাওয়া করেন। পায়ে তেল মালিশ করে দেন।
দিন সাতেক পর নানাজান ঘোষণা করলেন, তিনি বেশিদিন বাঁচবেন না। সম্পত্তির বিলি বন্দোবস্ত করতে চান। নবুমামার কাছে চিঠি গেল তিনি যেন পত্রপাঠ চলে আসেন, পড়াশুনার আর প্রয়োজন নাই। লোক পাঠিয়ে দামি কাফনের কাপড় কেনালেন। কবরের জন্য জায়গা ঠিক করা হল। কবর পাকা করবার জন্য ইট আনানো হল। মৌলানা ডাকিয়ে তওবা করলেন। বাড়ির সবাই এই নিঃশব্দ মৃত্যুর প্রস্তুতি দেখতে লাগল। ঠিক এই সময় বুড়ো নানীজান মারা গেলেন।
মোহরের মা রোজ সকালে দুধ নিয়ে যায় নানিজানের ঘরে। সেদিন কি কারণে যে দেরি হয়েছে। দুপুরের দিকে বাটিভর্তি দুধ নিয়ে গিয়েছেন। ঘরে ঢুকেই বিকট চিৎকার। মৃত্যু এসেছে নিঃশব্দে। কেউ জানতেও পারেনি কখন কিভাবে মারা গেলেন।
আমরা সবাই তার ঘরের সামনে ভিড় করে দাঁড়ালাম। পরিপাটি বিছানা পাতা। বালিশের চাদর পর্যন্ত একটুও কুচকায়নি। বড়ো নানীজান সেই পরিপাটি বিছানায় শক্ত হয়ে পড়ে আছেন। ইদুর কিংবা অন্য কোন কিছু তার ঠোঁট আর একটি চোখ খেয়ে গিয়েছে। বিকট হা করা সেই মৃত্যু দেখে সুফুরা খালা ও মাগো, ও মাগো বলে কাঁদতে লাগলেন। লালমামি সফুরা খালার হাত ধরে তাকে নিচে নামিয়ে নিয়ে গেলেন।
নানাজানের জন্য কেনা। কাফনের কাপড়ে তার কাফন হল। নানাজানের জন্যে ঠিক করে রাখা জায়গায় কবর হল তার। যে ইট নানাজান নিজের জন্যে আনিয়েছিলেন, সেই ইট দিয়ে কবব বাধিয়ে দেওয়া হল।
সপ্তাহ খানিকের মধ্যে আমরা সবাই বড় নানীজনের কথা ভুলে গেলাম। আগের মত ঝগড়া, রঙ-তামাশা চলতে লাগল। বড় নানীজনের ঘর থেকে তার সমস্ত জিনিস সরিয়ে ফেলে সংসারের প্রয়োজনীয় পেঁয়াজ রসুন রাখা হল গাদা করে।
দিন কেটে যেতে লাগল। একঘেয়ে বৈচিত্র্যহীন জীবন। সেই একা একা হাঁটতে হাঁটতে সোনাখালী চলে যাওয়া। পুকুরঘাটে রাতের বেলা চুপচাপ বসে থাকা। এর বাইরে যেন আমার জন্যে কোনো জগৎ নেই। সমস্ত বাসনা-কামনা এইটুকুতেই কেন্দ্রীভূত। এর মধ্যে একদিন নানাজান আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে গেছেন। বলেছেন,
তোমার বড় নানীজান তার নিজের সম্পত্তি তোমাকে আর লিলিকে দিয়ে গিয়েছেন দানপত্র করে।
বড় নানীজান তার বাবার কাছ থেকে প্রচুর সম্পত্তি পেয়েছিলেন জানতাম, তার পরিমাণ যে কত তা কেউ জানত না। নানাজান বললেন, অনেক জায়গা-জমি, লিলির আসা দরকার। কিন্তু তার ঠিকানা তো জানা নেই।



চলবে,,,,,,,,,,,,

No comments

Powered by Blogger.