হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস "অচিনপুর" দ্বিতীয়-পর্ব । @মিঃ মধু
---অচিনপুর---
(দ্বিতীয়-পর্ব)
আশ্বিন মাস আসতেই সাজ সাজ পড়ে গেল স্কুলে।
স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। গান, তো হবেই, সেই সঙ্গে নাটক হবে স্টেজ বেঁধে। হিরণ্য রাজা নাটকের নাম। হিরণ্য রাজার পাঠ করেছেন বাদশা মামা। উৎসাহের সীমা নেই। আমাদের। খালারাও ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলেন নাটক দেখবার জন্যে। মেয়েদের জন্যে পর্দাঘেরা আলাদা জায়গা করা হয়েছে। এ বাড়ির মেয়েরা আগে কখনো নাটক-ফাটক কিছুই দেখেনি। দেখবার সখ খুব।
স্কুলের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী। গান, তো হবেই, সেই সঙ্গে নাটক হবে স্টেজ বেঁধে। হিরণ্য রাজা নাটকের নাম। হিরণ্য রাজার পাঠ করেছেন বাদশা মামা। উৎসাহের সীমা নেই। আমাদের। খালারাও ঘ্যান ঘ্যান করতে লাগলেন নাটক দেখবার জন্যে। মেয়েদের জন্যে পর্দাঘেরা আলাদা জায়গা করা হয়েছে। এ বাড়ির মেয়েরা আগে কখনো নাটক-ফাটক কিছুই দেখেনি। দেখবার সখ খুব।
ছোট নানী আর্জি নিয়ে গেলেন নানাজনের কাছে।
এ সব কি দেখবে! না, না। বলে প্রথম দিকে প্রবল আপত্তি তুললেও শেষের দিকে তাকে কেমন নরম মনে হল। সুযোগ বুঝে নানীজান বলে চলেছেন, একদিনের মোটে ব্যাপার। আমোদ-আহাদ তো কিছু করে না।
না করে না, রাতদিনই তো আমোদ চলছে। আচ্ছা যাক। পালকি করে যেন যায়।
স্কুলঘরে স্টেজ সাজানো হয়েছে। হ্যাঁজাকের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। হ্যাঁরিকেন হাতে নিয়ে গ্রামের লোকজন আসছে। কাতারে কাতারে। পর্দায় আড়াল করা মেয়েদের জায়গায় তিল ধারনের ঠাই নেই।
এ সব কি দেখবে! না, না। বলে প্রথম দিকে প্রবল আপত্তি তুললেও শেষের দিকে তাকে কেমন নরম মনে হল। সুযোগ বুঝে নানীজান বলে চলেছেন, একদিনের মোটে ব্যাপার। আমোদ-আহাদ তো কিছু করে না।
না করে না, রাতদিনই তো আমোদ চলছে। আচ্ছা যাক। পালকি করে যেন যায়।
স্কুলঘরে স্টেজ সাজানো হয়েছে। হ্যাঁজাকের আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। হ্যাঁরিকেন হাতে নিয়ে গ্রামের লোকজন আসছে। কাতারে কাতারে। পর্দায় আড়াল করা মেয়েদের জায়গায় তিল ধারনের ঠাই নেই।
আমি আর নবুমামা বসেছি মেয়েদের সঙ্গে। ছোট নানী আর দুখালা চাদর গায়ে চুপচাপ বসে আছেন।
নাটক শুরু হতে হতে রাত হয়ে গেল। বাদশা মামা সেজেছেন হিরণ্য রাজা। এমন মহান রাজা দীন-দুঃখীদের জন্য সমস্ত বিলিয়ে দিচ্ছেন। দুশ্চরিত্র মন্ত্রি ঘোট পাকাচ্ছে তলে তলে। রাজা আপন-ভোলা মানুষ, কিছু জানতেও পারছেন না। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি সবাই। এক সময় হিরণ্য রাজা মনের দুঃখে রাজপ্রাসাদ ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছেন। রানীও তাঁর পিছু পিছু। নানীজান চমকে বললেন, মেয়ে কোথেকে এলো। কার মেয়ে?
ও হচ্ছে হারু দাদা, মেয়ে সেজেছে।
ওমা, হারু নাকি?
নানীজনের চোখে আর পলক পড়ে না। বিবেকের পাঠ করল আজমল। খালারা কাঁদতে কাঁদতে চাদর ভিজিয়ে ফেলল। শেষ দৃশ্যে হিরণ্য রাজা মন্ত্রীকে বলছেন–এই রাজ্য তুমি লাও ভাই। কাজ নাই রাজ্যপাটে, আমি বনবাসে যাব।
সেইখানে শান্তি অপার।
ছোট খালা বললেন, বেকুবটা মন্ত্রীকে মেরে ফেলে না কেন?
মন্ত্রী বলছে, দ্বন্দ্ব যুদ্ধ হোক রাজা, বৃথা তর্কে কোনো ফল নাই।
ঝন ঝন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নবুমামা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। নানীজান পেছনে থেকে চেঁচাচ্ছেন, ও নবু বস, দেখতে পাচ্ছি না। বসে পড়। কী তীব্র উত্তেজনা! রাজার মৃত্যুতে চোখে জল। বাদশা মামার জয়জয়কার। কী পাঠাটাই না করলেন!
নানাজানও যে শেষ পর্যন্ত অভিনয় দেখবেন, তা কেউ ভাবিনি। পালকিতে খালারা উঠতে যাবে, এমন সময় তিনি এসে হাজির। বাদশা তো বড় ভালো করেছে। এই বলে পালকিতে উঠবার তাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন হেডমাস্টার সাহেবের বাড়ি। সেখানে তার রাতের দাওয়াত।
বাড়ি গিযে দেখি মেহমানে বাড়ি ভর্তি। নন্দিপুর থেকে নানাজানের ফুপাতো বোন এসেছেন। ছেলেমেয়ে নিয়ে। সকাল-সকালই পৌঁছতেন, নৌকার দাঁড় ভেঙে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেছে। আমি আর নবুমামা অবাক হয়ে গেলাম মেহমানদের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়েকে দেখে। নানাজানের ফুপাতো বোনের বড় মেয়ে। ডাকনাম এলাচি। এমন সুন্দরও মানুষ হয়।
দু’মাসের ভেতর এলাচির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল বাদশা মামার। আপাত কাৰ্যকারণ ছাড়াই যে সমস্ত ক্ষুদ্র ব্যাপার ঘটে তা-ই কেমন করে পরবর্তী সময়ে মানুষের সমস্ত জীবন বদলে দেয়, ভাবতে অবাক লাগে।
সে রাতে নাটক দেখে সবাই বাদশা মামার উপর মহাপ্রসন্ন ছিলেন। বাড়ি এসে দেখেন, ফুলেব মত একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদশার সঙ্গে এর বিয়ে হলে কেমন হয়? এই ভাবনা চকিতে খেলে গেল সবার মনে। এলাচি স্থায়ীভাবে নানাজানের বাড়িতে উঠে এলেন। নাম হয়ে গেল। লাল বউ, আমি ডাকতাম লাল মামি, নবুমামা ডাকত লাল ভাবী। টকটকে বর্ণ, পাকা ডালিমের মত গাল। আর কি নামেই-বা ডাকা যায়!
নবুমামা এবং আমি দুজনে একইসঙ্গে লালমামির প্রেমে পড়ে গেলাম! সদা ঘুর ঘুর করি, একটু যদি ফুট-ফরমাস করতে দেন এই আশায়। লালমামি কাকে বেশি খাতির করেন, আমাকে, না নবুমামাকে এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে যায় দুজনের। স্কুলে যাবার পথে বইখাতা নামিয়ে হয় হাতাহাতি। লালমামির বড়ই খাবার ইচ্ছে হয়েছে, খেলা বন্ধ করে দুজনেই ছুটেছি ইন্দু সাহার বাড়ি। ইন্দু সাহার বাড়িতে দুটি বড়ই গাছ, মিষ্টি যেন গুড়। লালমামির ইচ্ছে হয়েছে কামরাঙ্গা খাবেন, ঝাল লংকা মাখিয়ে। বাড়ির পেছনে বিস্তৃত বন। এখানে-ওখানে গাছ আছে লুকিয়ে। দুজনেই গেছি বনে।
মেয়েরা খুব সহজেই ভালবাসা বুঝতে পারে। লালমামি আমাদের দুজনকেই বুঝে ফেললেন। পোষা বেড়ালের মত আমরা তার সঙ্গে বেড়াই। মোহরের মা বলে, পুলা দুটা মাইয়া স্বভাবের, এসব ভাল না গো।
আমি আর নবুমামা তখন নির্বাসিত হয়েছি পাশের ঘরে। কতটুকুই বা দূরে? লালমামি হাসছেন, আমরা শুনতে পারছি। লালমামি বলছেন, উঁহু, চুল ছিঁড়ে গেল। আমরা উৎকৰ্ণ হয়ে শুনছি। লালমামি যদি কখনো বলেছেন, এই যা, আজ খাওয়ার পানি-আনি নাই, ওমনি নবুমামা তড়াক করে লাফিয়ে পড়েছে বিছানা ছেড়ে, ভাবী, পানি নিয়ে আসছি আমি।
একঘেয়ে কোনো আকর্ষণেই আকর্ষণ থাকে না। মায়ের প্রতি মানুষের অন্ধ ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে একঘেয়েমির জন্যেই। ভাই-বোনের ভালবাসার ধরনও বদলাতে থাকে। লালমামির প্রতি আমাদের ভালবাসা ফিকে হওয়ার কোনো ভয় ছিল না। তার মত বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে আমি পরবর্তী জীবনে আর একটিমাত্র দেখেছিলাম।
যে কথা বলছিলাম–লালমামি আমাদের বিচিত্রভাবে আকর্ষণ করলেন। হয়ত আমি আর নবুমামা দুজনে বসে আছি তাঁর ঘরে। মামি হুকুম করলেন, নবু, দরজা বন্ধ করে দে। খোল, এবার আলমারি খোল। রাজার পোশাকটা বের করত।
আমি আঁৎকে উঠে বলেছি, বাদশা মামা মেরে ফেলবে। ঠোঁট উল্টে মামি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করেছেন, নে, তুই এই মুকুটটা পরে ফেলে। নবু, তুই কী সাজবি, সন্ন্যাসী?
নবুমামা বললেন, তুমি কী সাজবে আগে বল?
আমি রানী সাজব।
তাহলে আমি রাজা সাজব। ততক্ষণে আমি ঢলঢলে মুকুটটা মাথায় পরে ফেলেছি। তারস্বরে চেঁচাচ্ছি, না, আমি রাজা সাজব।
মামি বললেন, যুদ্ধ হোক দুজনার মধ্যে। যে জিতবে, সেই রাজা। কথা শেষ না হতেই নবুমামা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমার উপর। দুজন ধুলোমাখা মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। যেন এই যুদ্ধে জীবন-মরণ নির্ভর করছে। আল্লাহ জানেন, নবুমামা এই লিকলিকে শরীরে এত জোর পান কী করে?
জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতে দীর্ঘ সময় লাগে। মুখে নখের রক্তাভ আঁচড়ে, ধূলি-ধূসরিত শার্ট নিয়ে যখন যুদ্ধজয়ী রাজা দাঁড়ান। তখন মামি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, আজ আর না, আজ থাক, যা, তোরা আমার জন্য তেঁতুল নিয়ে আয়।
বল তো তুই, টানলে ছোট হয় কোন জিনিস?
লালমামি বিছানায় শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলেন। হাজার চিন্তাতেও মাথায় সে জিনিসটার নাম আসে না, টানলে যা ছোট হতে থাকে।
পারলি না? দেশলাই আন আমি দেখাচ্ছি।
নবুমামা দৌড়ে দেশলাই নিয়ে আসেন। মামি আমাদের দুজনের স্তম্ভিত চোখের সামনে ফস করে একটা বার্ডসাই সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকেন। কোন ফাকে জানি বাদশা মামার কাছ থেকে জোগাড় করে রেখেছিলেন। আমাদের দুজনের নিঃশ্বাস পড়ে না। মামি বলেন, এই দেখ, যতই টানছি, ততই ছোট হচ্ছে। আমরা হা করে তাকিযে থাকি মামির দিকে। মামি আধা-খাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে ধরেন আমাদের দিকে, শান্ত গলায় বলেন, নে এবাব তোরা টান। হা করে দেখছিস কি? কসে টান দে। নাইলে তো বাড়িতে বলে দিবি। মামিব মুখেব গন্ধ দূব করবাব জন্যে পানি আনতে হয়, এলাচ দানা আনতে হয়। সেই সঙ্গে মামির প্রতি আমাদের এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ জড় হতে থাকে।
বাড়ির বউ-ঝিরা লালমামিকে বিষ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। এ কেমন ধারা বউ? লাজ নেই, সহবত নেই।
কোথায় শাশুড়ীকে দেখে একহাত ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নয়, টগবগিয়ে ঘোড়ার মত চলে যায়। নতুন বউ রান্নাঘরে গিয়ে বসুক না দুদণ্ড। ননদের হাত থেকে আনাজ নিয়ে জোর করে কুটে দিক, তা নয়, গলায় বাঁশ দিয়ে হাসছে হিহিহিহি। মোহারের মা সময় বুঝে ছড়া কাটে। —
“রূপ আর কয়দিনের?
নিমতা ফুল যায়দিনের।”
নিমতা ফুল সক্কাল বেলাতেই ফোটে, রোদ একটু উঠতেই ঝর ঝর করে ঝড়ে পড়ে। কিন্তু যার জন্যে বলা সে শুনছে কই? শাশুড়ি মুখের ওপর কিছু বলেন না। লোকে বলবে, বউ কাটকী শাশুড়ী। কী লজ্জার কথা!
একমাত্র চাবিকাঠি বাদশা মামা। সে-ই তো পারে বউয়ের রীতিনীতি শুধরে দিতে। কিন্তু দেখেশুনে মনে হয়, বউ জাদু করেছে বাদশা মামাকে।
বিয়ের পর পরই বাদশা মামা ভয়ানক বদলে গেছেন। চাল-চলনে, কথা-বার্তায় ভয়ানক অস্থিরতা এসেছে। আগে সমস্ত দিন বাইরে পড়ে থাকতেন। রাতের বেলা খেতে আসতেন, বাড়ির সঙ্গে এইটুকুই যা সংযোগ। এখন সমস্ত দিন বাড়িতে থাকেন। কিন্তু সে-ও অন্যরকম থাকা। হয়ত মিনিট খানিকের জন্যে লাল মামির ঘরে এসেছেন, চোখে-মুখে ব্যস্ততার ভার। যেন কোনো দরকারী জিনিস খুঁজে পাচ্ছেন না। লাল মামি ভ্র কুঁচকে বললেন, কি চাও?
কি না, কিছু না।
বলে মামা বিব্রত ভঙ্গিতে চলে গেলেন। বসে রইলেন বাইরের ঘরে একা একা। আবার হয়ত আসলেন কিছুক্ষণের জন্যে, আবার বাইরে গিয়ে বসে থাকা। নানীজান একদিন বললেন— বাদশা, কী হয়েছে রে?
বাদশা মামা কিছু বললেন না। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
সবাই অবাক হল, যেদিন বাদশা মামা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। নানাজান সে দিনই প্রথম লালমামির ঘরে এসে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এলাচি বাদশার কী হয়েছে?
লালমামি চুপ করে রইলেন। নানাজান বললেন, তোমাদের মিল হয় না কেন? কি ব্যাপার?
মামি চুপ করে রইলেন। নানাজান শান্ত গলায় বললেন, এলাচি, সরফরাজ খানের বাড়িতে কোনো বেচাল হয় না। খেয়াল থাকে যেন।
নানাজান বেরিয়ে এসে ছোট নানীজনকে কিছুক্ষণ বকে নিচে নেমে গেলেন। সারাদিন বাড়ি থম থম করতে লাগল। সে সন্ধ্যায় কানাবিবি যখন সাপ-খেলানো সুরে কোরান পড়তে শুরু করল তখন কেন জানি না। ভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল।
তৃতীয় দিনের দিন সকালবেলা বাদশা মামা ফিরে এলেন। ভেতরের বাড়িতে না এসে বাইরের ঘরে বসে রইলেন। নানীজান এসে তাকে নিয়ে গেলেন ভেতর বাড়িতে। নানা সারক্ষণই সংকুচিত হয়ে রইলেন। যখন লালমামির সঙ্গে তার দেখা হল তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন।
সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপারটি হল রাতে। বাদশা মামা লালমামির ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। মামি বললেন, কে?
বাদশা মামা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, আমি।
এদিকে পাশের ঘরে আমি আর নবুমামা কান খাড়া করে বসে আছি। কিন্তু আর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বাদশা মামা নিচু গলায় বললেন, দরজাটা খোল।
লালমামি কোনো সাড়া-শব্দ করলেন না। শেষ পর্যন্ত বাদশা মামা আমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। আমরা তিনজন একখাটে শুয়ে রইলাম। মামা বার বার বলছেন, কাউকে বলবি না, খবরদার।
না!
বললে কান ছিঁড়ে ফেলব। দুজনের মনে থাকে যেন।
ভাদ্রমাসের প্রথমদিকে নবুমামা অসুখে পড়লেন, কালান্তক ম্যালেরিয়া। হাত-পা শুকিয়ে কাঠি, পেট ফুলে ঢোল। উঠোনে ছেলেমেয়ের হুল্লোড় করে বেড়ায়, নবুমামা চাদর গায়ে দিয়ে জলচৌকিতে বসে বসে দেখে। ম্যালেরিয়ার তখন খুব ভাল ওষুধ বেরিয়েছে। গাঢ় হলুদ রঙের কুইনাইন ট্যাবলেট। সেকালের এক পয়সার মত বড়ো, আস্ত গেলা যায় না। গলায় আটকে থাকে। সপ্তাহে একদিন খাবার নিয়ম, ম্যালেরিয়া হোক আর না-হোক। ওষুধ খেলেই কান ভো ভো করত, মাথা হাল্কা হয়ে যেত।
কুইনাইন খেয়ে খেয়ে এসময় নবুমামার জ্বর সারল। শরীর খুব দুর্বল। নিজে নিজে দাঁড়াতে পারে না। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করে, এটা খাবে, ওটা খাবে। খিটখিটে মেজাজ। যদি কোনো কারণে লালমামি আমার দিকে তাকিয়ে হোসেছেন, অমনি তার রাগ হয়ে গেছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে হাস। শুনে লালমামি নিষ্ঠুরের মত বলে বসেন, তোর দিকে তাকিয়ে হাসব কি রে, তুই তো চামচিকা হয়ে গেছিস।
নবুমামার আকাশ-ফাটানো কান্না থামাবার জন্যে লালমামিকে অনেকক্ষণ নবুমামার দিকে তাকিয়ে হাসতে হয়। স্বাস্থ্যের জন্যে নুবুমামার স্কুলে যাওয়াও বন্ধু। রোগা শরীর পেয়ে বিভিন্ন রোগ ইচ্ছে মত ছেঁকে ধরেছে, আজ সর্দি তো কাল জ্বর, পরশু পেট নেমেছে।
কানাবিবির দেওয়া তাবিজের ঝোলা গলায় দিয়ে নমুমামা বেচারার মতো ঘুরে বেড়ায়। রাতের বেলা বড়ো জ্বালাতন করে। কিছুক্ষণ পর পর পানি খেতে চায়। পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার তার পেচ্ছাবের বেগ হয়। পেচ্ছাব করানোও কী কম হাঙ্গামা? হ্যাঁরিকেন জ্বালাতে হয়, নবুমামা হাতে নেন একটা টর্চ। আমাকে গিয়ে ডেকে তুলতে হয় নানীজানকে। নানীজান আর আমি বসে থাকি বারান্দায়। নমু মামা টর্চ ফেলে ভয়ে ভয়ে যান। তাতেও রক্ষা নেই, ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠেছেন, ওটা কী, ঐ যে গেল?
কিছু না, শেয়াল।
শেয়াল? তবে ছায়া পড়ল না কেন?
অন্ধকারে ছায়া পড়বে কি রে হাঁদা? নানীজান বিরক্ত হয়ে বলেন।
এই হল নিত্যকার রুটিন।
খাওয়া নিয়েও কী কম হাঙ্গামা! আজি ইচ্ছে হয়েছে কইমাছ ভাজা খাবেন। কইমাছ জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ। সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
শেষ পর্যন্ত পীর-ফকির ধরা হল। ধর্মনগরের সুফি সাহেবের পানিপড়া আনবার জন্যে আমি আর বাদশা মামা নৌকা করে ধর্মনগর রওনা হলাম। দু’দিনের পথ। উজান ঠেলে যেতে হয়। সঙ্গে চাল ডাল নিয়ে নিয়েছি। নৌকাতেই খাওয়া-দাওয়া। বাদশা মামা এই দীর্ঘ সময় চুপচাপ কাটালেন। সন্ধ্যার পর নৌকার ছাদে উঠে বসেন। নেমে আসেন। অনেক রাতে। সারাদিন শুয়ে শুয়ে ঘুমান। দেখলেই বোঝা যায়। ভরসা হারানো মানুষ। কিন্তু কী জন্যে ভরসা হারিয়েছেন তা বুঝতে না পেরে আমার খারাপ লাগে।
সপ্তম দিনে ফিরলাম। সুফি সাহেব খুব খাতির-যত্ন করলেন আমাদের। তাঁর অনুরোধে বাড়িতে চারদিন থেকে যেতে হল। কথা নেই বার্তা নেই, বাদশা মামা সুফি সাহেবের মুরিদ হয়ে গেলেন। মাথায় সব সময় টুপি, নিয়ম করে নামাজ পড়ছেন। যতই দেখি ততই অবাক হই।
আমার অবাক হওয়ার আরো কিছু বাকি ছিল। বাড়িতে ফিরে জানলাম, নকুমামা খুলনা জেলার মনোহরদীপুরে চলে যাচ্ছেন। কিছুদিন সেখানে থাকবেন। খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা, শরীর ফিরলে চলে যাবেন রাজশাহী। নানাজানের খালাতো ভাই থাকেন সেখানে। সরকারি জরিপ বিভাগের কানুনগো। নবুমামা সেখানে থেকেই পড়াশুনা করবেন। নানাজান নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে তারই আয়োজন চলছে। নবুমামা আগের চেয়েও মিইয়ে গিয়েছেন। আমাকে ধরা গলায় বললেন, লাল ভাবীকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
আমি ভেবেই পেলাম না একা একা আমি কী কবে থাকব। নব্বুমামা আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া একা একা স্কুলে যাচ্ছি। এই দৃশ্য কল্পনা করলেও চোখে পানি এসে যায়। নবুমামার আমার জন্যে কোনো মাথাব্যথা নেই, তার মুখে শুধুই লাল ভাবীর কথা। আমি বললাম,
নবুমামা, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান।
আমি কী করে নিয়ে যাব? তুই বাবাকে বল।
নানাজানকে বলবার সাহস আমার নেই। আমি লালমামিকে ধরলাম। মামি তখন বারান্দায় বসে সুচ-সুতো নিয়ে কী যেন করছিলেন। আমি কাঁদো-কাঁদো হয়ে সমস্ত খুলে বললাম। চুপ করে তিনি সমস্ত শুনলেন। আমার কথা শেষ হতেই বললেন, যা তো, দৌড়ে তোর ছোট খালার কাছ থেকে একটা সোনামুখী সুচ নিয়ে আয়। বলবি আমি চাইছি।
সুচ এনে দিয়ে আমার কাতর অনুরোধ জানালাম।
বলবেন তো মামি? আজই বলতে হবে। আজি সন্ধ্যা বেলাতেই।
মামি বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ঘ্যান ঘ্যান করিস, পরের বাড়িতে আছিস যে কুঁশ নেই? ইচ্ছে হয় নিজে গিয়ে বল।
এর কিছুদিন পরই পানশী নৌকা করে নানাজান আর নবুমামা চলে গেলেন। যাবার সময় নবুমামার সে কী কান্না! কিছুতেই যাবে না। লালমামির শাড়ি চেপে ধরেছে। তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, আমি যাব না, যাব না।
লালমামি শুকনো গলায় বললেন, শাড়ি ছাড়, শাড়ি ধরে চেঁচাচ্ছিস কেন?
নবুমামা চলে যাবার পর আমার কিছু করবার রইল না। আম-কঁঠালের ছুটি হয়ে গেছে স্কুল। সারাদিন বাড়িতে ঘুরে বেড়াই। বিকেল বেলাটা আর কিছুতেই কাটে না। রোদের তাপ একটু কমতেই হাঁটতে হাটতে চলে যাই সোনাখালী। হেঁটে যেতে যেতে কত আজগুবি চিন্তা মনে আসে। যেন কোন অপরাধ ছাড়াই দেশের রাজা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। হুকুম হয়েছে, আমার ফাঁসি হবে। রাজ্যের সমস্ত লোক ফাঁসির মঞ্চের চারদিকে জড় হয়েছে। আমি তাকিয়ে দেখি, এদের মধ্যে লাল রঙের পোশাক পরা একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, না, এ ছেলে কোনো দোষ করেনি, এর ফাঁসি হবে না। বলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলেছে। আমি বলছি, না, হোক, আমার ফাঁসি হোক। মেয়েটি অপলকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার মুখের গড়ন অনেকটা লালমামির মত।
সোনাখালী পাকাপুলে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতাম। সেই সময় আমার মন থেকে ভূতের ভয় কেটে গিয়েছিল। একেক দিন নিশীথ রাতে একা এক ফিরেছি। অন্ধকারে একা ফিরতে ফিরতে কতবার চমকে উঠেছি নাম-না-জানা পাখির ডাকে। কিন্তু ভয় পাইনি কখনো। রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালেই মোহরের মা ভাত বেড়ে দেয়, নাও, খেয়ে গুণ্ঠী উদ্ধার কর। এইসব কথা কখনো গায়ে মাখি না।
আমি সে সময় অনেক বড়ো দুঃখে৷ ডুবে ছিলাম। ছোটখাটো কষ্টের ব্যাপার, যা প্রতিদিন ঘটত, এই নিয়ে সেই কারণেই কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
দিন আর কাটতে চায় না কিছুতেই। স্নেহ, ভালবাসা ছাড়া কোনো মানুষই বাঁচতে পারে না। আমি সেই কারণেই হয়ত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে সময় কাটাই। কেন জানি না, অসুখটাই ভাল লাগে। সকাল থেকে সন্ধা শুয়ে শুয়ে ঘুমানো ছাড়া অন্য কাজ নেই। মাঝে-মধ্যে বাদশামামা এসে বসেন। নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তা হয়। মামা হয়ত বললেন,
বেশি করে দুধ খা, শরীরে জোর হবে।
আচ্ছা মামা, খাব।
পীরপুরে জন্মাষ্টমির মেলা, যাবি নাকি দেখতে?
অসুখ সারলে যাব।
মামা থাকেন অল্পক্ষণ। কথা বলেন ছাড়া-ছাড়া ভঙ্গিতে। দেখে-শুনে বড় অবাক লাগে। তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। গাল বসে গিয়ে কেমন প্রৌঢ় মানুষের মত দেখায়।
লালমামি বড়-একটা আসেন না। হয়ত দরজার বাইরে থেকে বললেন,
রঞ্জর জ্বর আবার এসেছে নাকি?
না মামি, জ্বর নেই।
না থাকলেই ভাল। এই বলে তিনি ব্যস্তভাবে চলে যান। তাঁর যাওয়ার পথে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকি। সে সময়ে লালমামিকে আমি একইসঙ্গে ভালবাসি আর ঘৃণাও করি। কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি এ ধরনের দ্বৈত অনুভূতি–সে-ই আমার প্রথম। পরবর্তী সময়ে অবশ্যি আরো অনেকের জন্যেই এমন হয়েছে।
ঠিক এ সময়ে আমার সফুরা খালার সঙ্গে অল্পমাত্রায় ঘনিষ্ঠতা হল। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হবে এ আমার খুব ছোটবেলাকার বাসনা। তিনি আমার চেয়ে বছরখানেকের বড়ো হবেন। খুব চুপচাপ ধরনের মানুষ। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, তিনি একা-একা হেঁটে বেড়াচ্ছেন বারান্দায়। হাতে একটা লাঠি। মাঝে মাঝে ঠক ঠক করে শব্দ করছে আর মুখে বলছেন, উড়ে গেল পাখি। প্রথমদিন এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি! তিনি আমাকে দেখতে পাননি, কাজেই তিনি লাঠি হাতে ঠক ঠক করতে লাগলেন আর পাখি ওড়াতে লাগলেন। আমি যখন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
খালা, কী করেন?
লজ্জায় খালার চোখে পানি এসে গেল। কোনো রকমে বললেন,
কিছু না, আমি খেলি। তারপরও খালাকে এমন অদ্ভুত খেলা খেলতে দেখেছি। লজ্জা পাবেন এই জন্যে আমি তার সামনে পড়িনি। তাঁর সঙ্গে ভাব করবার আমার খুব ইচ্ছে হত। কিন্তু তিনি আমাকে দেখলেই ভারি লজ্জা পেতেন।
অসুখের সময় প্রায়ই সফুরা খালা এসে দাঁড়াতেন আমার দরজায়। আমি ডাকতাম,
খালা, ভেতরে আসেন।
না, আমি এখানেই থাকি।
এই বলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন দরজায়। অনেক রকম কথা হত তার সাথে। কী ধরনের কথা তা আজ আর মনে নেই, মনে আছে, খালা সারাক্ষণই মুখ টিপে টিপে হাসতেন।
খালা মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব গল্প করতেন।
একদিন এসে বললেন, কাল রাতে ভারি আশ্চর্য একটি ব্যাপার হয়েছে রঞ্জু। ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই দেখি একটি ফুটফুটে পরী আমার খাটে বসে আছে। আমি তো অবাক! তারপর পরীটি অনেক গল্প করল আমার সঙ্গে। ভোর হয়ে আসছে। যখন তখন সে বলল, আমি যাই। আমি বললাম, ও ভাই পরী, তোমার পাখায় একটু হাত দেব? সে বলল, দাও না। আমি পরীর পাখায় হাত বুলিয়ে দেখলাম, কী তুলতুলে পাখা। আর সেই থেকে আমার হাতে মিষ্টি গন্ধ। দেখি না শুঁকে।
আমি সফুরা খালার হাত শুকতেই বকুল ফুলের গন্ধ পেলাম। খালা হয়ত অনেকক্ষণ বকুল ফুলের মালা হাতে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তারই গন্ধ। সফুরা খালা সত্যি ভারি অদ্ভুত মেয়ে ছিল। এক রাতে ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। আমি লিলিকে স্বপ্নে দেখলাম। সে ঠিক আগেকার মত অভিভাবকসুলভ ভঙ্গি করে বলছে, রঞ্জু, তোর একটুও যত্ন হচ্ছে না। এখানে। তুই আমার কাছে চলে আয়।
আমি লিলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কত দিন হয়েছে সে চলে গেছে। এ দীর্ঘদিনেও তার কথা কেন যে মনে পড়ল না! স্বপ্ন ভেঙে আমার খুব অবাক লাগল। লিলি যে দেখতে কেমন ছিল তাও পৰ্যন্ত আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, তার চিবুকটা লম্বাটে ধরনের ছিল। সেখানে একটা লাল রঙ্গের তিল ছিল। লিলি ছোটবেলায় আমাকে এই তিল দেখিয়ে বলত, রঞ্জু, এই তিলটিা যদি কপালে থাকত, তাহলে আমি রাজরানী হতাম।
দীর্ঘদিন পর লিলিকে স্বপ্নে নিখুঁতভাবে দেখলাম। এবং সে রাতেই ঠিক করলাম, ঘুম ভাঙতেই নানাজানের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে লিলিকে চিঠি দেব। এই মনে করে আমার খুব ভাল লাগতে লাগল। মনে হল শরীর সেরে গেছে, একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাই।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই জোছনা দেখে চোখ ছলছলিয়ে উঠল। এমন উথাল-পাথাল আলো দেখলে মানুষের মনে এত দুঃখ আসে। কেন কে জানে?
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। পা যখন ধরে এলো তখন দেয়াল ঘেঁষে বসে রইলাম। হঠাৎ শুনি পাশের ঘরে লালমামি কাঁদছেন।
কোনো ভুল নেই, স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মামাও যেন নিচু গলায় কি একটা বললেন। মামি কান্না থামিয়ে ধমকে উঠলেন, কোনো কথা শুনব না। আমি।
বাইরের এই অপূর্ব জোছনার সঙ্গে এই ঘটনা কেমন যেন মিশ খায় না। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
ও হচ্ছে হারু দাদা, মেয়ে সেজেছে।
ওমা, হারু নাকি?
নানীজনের চোখে আর পলক পড়ে না। বিবেকের পাঠ করল আজমল। খালারা কাঁদতে কাঁদতে চাদর ভিজিয়ে ফেলল। শেষ দৃশ্যে হিরণ্য রাজা মন্ত্রীকে বলছেন–এই রাজ্য তুমি লাও ভাই। কাজ নাই রাজ্যপাটে, আমি বনবাসে যাব।
সেইখানে শান্তি অপার।
ছোট খালা বললেন, বেকুবটা মন্ত্রীকে মেরে ফেলে না কেন?
মন্ত্রী বলছে, দ্বন্দ্ব যুদ্ধ হোক রাজা, বৃথা তর্কে কোনো ফল নাই।
ঝন ঝন যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। নবুমামা উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। নানীজান পেছনে থেকে চেঁচাচ্ছেন, ও নবু বস, দেখতে পাচ্ছি না। বসে পড়। কী তীব্র উত্তেজনা! রাজার মৃত্যুতে চোখে জল। বাদশা মামার জয়জয়কার। কী পাঠাটাই না করলেন!
নানাজানও যে শেষ পর্যন্ত অভিনয় দেখবেন, তা কেউ ভাবিনি। পালকিতে খালারা উঠতে যাবে, এমন সময় তিনি এসে হাজির। বাদশা তো বড় ভালো করেছে। এই বলে পালকিতে উঠবার তাড়া দিয়ে তিনি চলে গেলেন হেডমাস্টার সাহেবের বাড়ি। সেখানে তার রাতের দাওয়াত।
বাড়ি গিযে দেখি মেহমানে বাড়ি ভর্তি। নন্দিপুর থেকে নানাজানের ফুপাতো বোন এসেছেন। ছেলেমেয়ে নিয়ে। সকাল-সকালই পৌঁছতেন, নৌকার দাঁড় ভেঙে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেছে। আমি আর নবুমামা অবাক হয়ে গেলাম মেহমানদের মধ্যে অদ্ভুত সুন্দর একটি মেয়েকে দেখে। নানাজানের ফুপাতো বোনের বড় মেয়ে। ডাকনাম এলাচি। এমন সুন্দরও মানুষ হয়।
দু’মাসের ভেতর এলাচির সঙ্গে বিয়ে হয়ে গেল বাদশা মামার। আপাত কাৰ্যকারণ ছাড়াই যে সমস্ত ক্ষুদ্র ব্যাপার ঘটে তা-ই কেমন করে পরবর্তী সময়ে মানুষের সমস্ত জীবন বদলে দেয়, ভাবতে অবাক লাগে।
সে রাতে নাটক দেখে সবাই বাদশা মামার উপর মহাপ্রসন্ন ছিলেন। বাড়ি এসে দেখেন, ফুলেব মত একটি মেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাদশার সঙ্গে এর বিয়ে হলে কেমন হয়? এই ভাবনা চকিতে খেলে গেল সবার মনে। এলাচি স্থায়ীভাবে নানাজানের বাড়িতে উঠে এলেন। নাম হয়ে গেল। লাল বউ, আমি ডাকতাম লাল মামি, নবুমামা ডাকত লাল ভাবী। টকটকে বর্ণ, পাকা ডালিমের মত গাল। আর কি নামেই-বা ডাকা যায়!
নবুমামা এবং আমি দুজনে একইসঙ্গে লালমামির প্রেমে পড়ে গেলাম! সদা ঘুর ঘুর করি, একটু যদি ফুট-ফরমাস করতে দেন এই আশায়। লালমামি কাকে বেশি খাতির করেন, আমাকে, না নবুমামাকে এই নিয়ে ঝগড়া হয়ে যায় দুজনের। স্কুলে যাবার পথে বইখাতা নামিয়ে হয় হাতাহাতি। লালমামির বড়ই খাবার ইচ্ছে হয়েছে, খেলা বন্ধ করে দুজনেই ছুটেছি ইন্দু সাহার বাড়ি। ইন্দু সাহার বাড়িতে দুটি বড়ই গাছ, মিষ্টি যেন গুড়। লালমামির ইচ্ছে হয়েছে কামরাঙ্গা খাবেন, ঝাল লংকা মাখিয়ে। বাড়ির পেছনে বিস্তৃত বন। এখানে-ওখানে গাছ আছে লুকিয়ে। দুজনেই গেছি বনে।
মেয়েরা খুব সহজেই ভালবাসা বুঝতে পারে। লালমামি আমাদের দুজনকেই বুঝে ফেললেন। পোষা বেড়ালের মত আমরা তার সঙ্গে বেড়াই। মোহরের মা বলে, পুলা দুটা মাইয়া স্বভাবের, এসব ভাল না গো।
আমি আর নবুমামা তখন নির্বাসিত হয়েছি পাশের ঘরে। কতটুকুই বা দূরে? লালমামি হাসছেন, আমরা শুনতে পারছি। লালমামি বলছেন, উঁহু, চুল ছিঁড়ে গেল। আমরা উৎকৰ্ণ হয়ে শুনছি। লালমামি যদি কখনো বলেছেন, এই যা, আজ খাওয়ার পানি-আনি নাই, ওমনি নবুমামা তড়াক করে লাফিয়ে পড়েছে বিছানা ছেড়ে, ভাবী, পানি নিয়ে আসছি আমি।
একঘেয়ে কোনো আকর্ষণেই আকর্ষণ থাকে না। মায়ের প্রতি মানুষের অন্ধ ভালবাসা ফিকে হয়ে আসে একঘেয়েমির জন্যেই। ভাই-বোনের ভালবাসার ধরনও বদলাতে থাকে। লালমামির প্রতি আমাদের ভালবাসা ফিকে হওয়ার কোনো ভয় ছিল না। তার মত বিচিত্র স্বভাবের মেয়ে আমি পরবর্তী জীবনে আর একটিমাত্র দেখেছিলাম।
যে কথা বলছিলাম–লালমামি আমাদের বিচিত্রভাবে আকর্ষণ করলেন। হয়ত আমি আর নবুমামা দুজনে বসে আছি তাঁর ঘরে। মামি হুকুম করলেন, নবু, দরজা বন্ধ করে দে। খোল, এবার আলমারি খোল। রাজার পোশাকটা বের করত।
আমি আঁৎকে উঠে বলেছি, বাদশা মামা মেরে ফেলবে। ঠোঁট উল্টে মামি তাচ্ছিল্যের ভঙ্গি করেছেন, নে, তুই এই মুকুটটা পরে ফেলে। নবু, তুই কী সাজবি, সন্ন্যাসী?
নবুমামা বললেন, তুমি কী সাজবে আগে বল?
আমি রানী সাজব।
তাহলে আমি রাজা সাজব। ততক্ষণে আমি ঢলঢলে মুকুটটা মাথায় পরে ফেলেছি। তারস্বরে চেঁচাচ্ছি, না, আমি রাজা সাজব।
মামি বললেন, যুদ্ধ হোক দুজনার মধ্যে। যে জিতবে, সেই রাজা। কথা শেষ না হতেই নবুমামা ঝাঁপিয়ে পড়েন। আমার উপর। দুজন ধুলোমাখা মেঝেতে গড়াগড়ি খেতে থাকি। যেন এই যুদ্ধে জীবন-মরণ নির্ভর করছে। আল্লাহ জানেন, নবুমামা এই লিকলিকে শরীরে এত জোর পান কী করে?
জয়-পরাজয় নির্ধারিত হতে দীর্ঘ সময় লাগে। মুখে নখের রক্তাভ আঁচড়ে, ধূলি-ধূসরিত শার্ট নিয়ে যখন যুদ্ধজয়ী রাজা দাঁড়ান। তখন মামি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলেন, আজ আর না, আজ থাক, যা, তোরা আমার জন্য তেঁতুল নিয়ে আয়।
বল তো তুই, টানলে ছোট হয় কোন জিনিস?
লালমামি বিছানায় শুয়ে পা দোলাতে দোলাতে বলেন। হাজার চিন্তাতেও মাথায় সে জিনিসটার নাম আসে না, টানলে যা ছোট হতে থাকে।
পারলি না? দেশলাই আন আমি দেখাচ্ছি।
নবুমামা দৌড়ে দেশলাই নিয়ে আসেন। মামি আমাদের দুজনের স্তম্ভিত চোখের সামনে ফস করে একটা বার্ডসাই সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকেন। কোন ফাকে জানি বাদশা মামার কাছ থেকে জোগাড় করে রেখেছিলেন। আমাদের দুজনের নিঃশ্বাস পড়ে না। মামি বলেন, এই দেখ, যতই টানছি, ততই ছোট হচ্ছে। আমরা হা করে তাকিযে থাকি মামির দিকে। মামি আধা-খাওয়া সিগারেট বাড়িয়ে ধরেন আমাদের দিকে, শান্ত গলায় বলেন, নে এবাব তোরা টান। হা করে দেখছিস কি? কসে টান দে। নাইলে তো বাড়িতে বলে দিবি। মামিব মুখেব গন্ধ দূব করবাব জন্যে পানি আনতে হয়, এলাচ দানা আনতে হয়। সেই সঙ্গে মামির প্রতি আমাদের এক নিষিদ্ধ আকর্ষণ জড় হতে থাকে।
বাড়ির বউ-ঝিরা লালমামিকে বিষ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল। এ কেমন ধারা বউ? লাজ নেই, সহবত নেই।
কোথায় শাশুড়ীকে দেখে একহাত ঘোমটা দিয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে, তা নয়, টগবগিয়ে ঘোড়ার মত চলে যায়। নতুন বউ রান্নাঘরে গিয়ে বসুক না দুদণ্ড। ননদের হাত থেকে আনাজ নিয়ে জোর করে কুটে দিক, তা নয়, গলায় বাঁশ দিয়ে হাসছে হিহিহিহি। মোহারের মা সময় বুঝে ছড়া কাটে। —
“রূপ আর কয়দিনের?
নিমতা ফুল যায়দিনের।”
নিমতা ফুল সক্কাল বেলাতেই ফোটে, রোদ একটু উঠতেই ঝর ঝর করে ঝড়ে পড়ে। কিন্তু যার জন্যে বলা সে শুনছে কই? শাশুড়ি মুখের ওপর কিছু বলেন না। লোকে বলবে, বউ কাটকী শাশুড়ী। কী লজ্জার কথা!
একমাত্র চাবিকাঠি বাদশা মামা। সে-ই তো পারে বউয়ের রীতিনীতি শুধরে দিতে। কিন্তু দেখেশুনে মনে হয়, বউ জাদু করেছে বাদশা মামাকে।
বিয়ের পর পরই বাদশা মামা ভয়ানক বদলে গেছেন। চাল-চলনে, কথা-বার্তায় ভয়ানক অস্থিরতা এসেছে। আগে সমস্ত দিন বাইরে পড়ে থাকতেন। রাতের বেলা খেতে আসতেন, বাড়ির সঙ্গে এইটুকুই যা সংযোগ। এখন সমস্ত দিন বাড়িতে থাকেন। কিন্তু সে-ও অন্যরকম থাকা। হয়ত মিনিট খানিকের জন্যে লাল মামির ঘরে এসেছেন, চোখে-মুখে ব্যস্ততার ভার। যেন কোনো দরকারী জিনিস খুঁজে পাচ্ছেন না। লাল মামি ভ্র কুঁচকে বললেন, কি চাও?
কি না, কিছু না।
বলে মামা বিব্রত ভঙ্গিতে চলে গেলেন। বসে রইলেন বাইরের ঘরে একা একা। আবার হয়ত আসলেন কিছুক্ষণের জন্যে, আবার বাইরে গিয়ে বসে থাকা। নানীজান একদিন বললেন— বাদশা, কী হয়েছে রে?
বাদশা মামা কিছু বললেন না। ফ্যালফ্যালিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
সবাই অবাক হল, যেদিন বাদশা মামা কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে উধাও হয়ে গেলেন। নানাজান সে দিনই প্রথম লালমামির ঘরে এসে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এলাচি বাদশার কী হয়েছে?
লালমামি চুপ করে রইলেন। নানাজান বললেন, তোমাদের মিল হয় না কেন? কি ব্যাপার?
মামি চুপ করে রইলেন। নানাজান শান্ত গলায় বললেন, এলাচি, সরফরাজ খানের বাড়িতে কোনো বেচাল হয় না। খেয়াল থাকে যেন।
নানাজান বেরিয়ে এসে ছোট নানীজনকে কিছুক্ষণ বকে নিচে নেমে গেলেন। সারাদিন বাড়ি থম থম করতে লাগল। সে সন্ধ্যায় কানাবিবি যখন সাপ-খেলানো সুরে কোরান পড়তে শুরু করল তখন কেন জানি না। ভয়ে আমার বুক কাঁপতে লাগল।
তৃতীয় দিনের দিন সকালবেলা বাদশা মামা ফিরে এলেন। ভেতরের বাড়িতে না এসে বাইরের ঘরে বসে রইলেন। নানীজান এসে তাকে নিয়ে গেলেন ভেতর বাড়িতে। নানা সারক্ষণই সংকুচিত হয়ে রইলেন। যখন লালমামির সঙ্গে তার দেখা হল তিনি ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন।
সবচেয়ে অবাক হওয়ার ব্যাপারটি হল রাতে। বাদশা মামা লালমামির ঘরের দরজায় টোকা দিলেন। মামি বললেন, কে?
বাদশা মামা নিষ্প্রাণ গলায় বললেন, আমি।
এদিকে পাশের ঘরে আমি আর নবুমামা কান খাড়া করে বসে আছি। কিন্তু আর কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। বাদশা মামা নিচু গলায় বললেন, দরজাটা খোল।
লালমামি কোনো সাড়া-শব্দ করলেন না। শেষ পর্যন্ত বাদশা মামা আমাদের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলেন। আমরা তিনজন একখাটে শুয়ে রইলাম। মামা বার বার বলছেন, কাউকে বলবি না, খবরদার।
না!
বললে কান ছিঁড়ে ফেলব। দুজনের মনে থাকে যেন।
ভাদ্রমাসের প্রথমদিকে নবুমামা অসুখে পড়লেন, কালান্তক ম্যালেরিয়া। হাত-পা শুকিয়ে কাঠি, পেট ফুলে ঢোল। উঠোনে ছেলেমেয়ের হুল্লোড় করে বেড়ায়, নবুমামা চাদর গায়ে দিয়ে জলচৌকিতে বসে বসে দেখে। ম্যালেরিয়ার তখন খুব ভাল ওষুধ বেরিয়েছে। গাঢ় হলুদ রঙের কুইনাইন ট্যাবলেট। সেকালের এক পয়সার মত বড়ো, আস্ত গেলা যায় না। গলায় আটকে থাকে। সপ্তাহে একদিন খাবার নিয়ম, ম্যালেরিয়া হোক আর না-হোক। ওষুধ খেলেই কান ভো ভো করত, মাথা হাল্কা হয়ে যেত।
কুইনাইন খেয়ে খেয়ে এসময় নবুমামার জ্বর সারল। শরীর খুব দুর্বল। নিজে নিজে দাঁড়াতে পারে না। মাথা ঘুরে পড়ে যায়। সারাদিন ঘ্যান ঘ্যান করে, এটা খাবে, ওটা খাবে। খিটখিটে মেজাজ। যদি কোনো কারণে লালমামি আমার দিকে তাকিয়ে হোসেছেন, অমনি তার রাগ হয়ে গেছে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে হাস। শুনে লালমামি নিষ্ঠুরের মত বলে বসেন, তোর দিকে তাকিয়ে হাসব কি রে, তুই তো চামচিকা হয়ে গেছিস।
নবুমামার আকাশ-ফাটানো কান্না থামাবার জন্যে লালমামিকে অনেকক্ষণ নবুমামার দিকে তাকিয়ে হাসতে হয়। স্বাস্থ্যের জন্যে নুবুমামার স্কুলে যাওয়াও বন্ধু। রোগা শরীর পেয়ে বিভিন্ন রোগ ইচ্ছে মত ছেঁকে ধরেছে, আজ সর্দি তো কাল জ্বর, পরশু পেট নেমেছে।
কানাবিবির দেওয়া তাবিজের ঝোলা গলায় দিয়ে নমুমামা বেচারার মতো ঘুরে বেড়ায়। রাতের বেলা বড়ো জ্বালাতন করে। কিছুক্ষণ পর পর পানি খেতে চায়। পানি খাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার তার পেচ্ছাবের বেগ হয়। পেচ্ছাব করানোও কী কম হাঙ্গামা? হ্যাঁরিকেন জ্বালাতে হয়, নবুমামা হাতে নেন একটা টর্চ। আমাকে গিয়ে ডেকে তুলতে হয় নানীজানকে। নানীজান আর আমি বসে থাকি বারান্দায়। নমু মামা টর্চ ফেলে ভয়ে ভয়ে যান। তাতেও রক্ষা নেই, ক্ষণে ক্ষণে চমকে উঠেছেন, ওটা কী, ঐ যে গেল?
কিছু না, শেয়াল।
শেয়াল? তবে ছায়া পড়ল না কেন?
অন্ধকারে ছায়া পড়বে কি রে হাঁদা? নানীজান বিরক্ত হয়ে বলেন।
এই হল নিত্যকার রুটিন।
খাওয়া নিয়েও কী কম হাঙ্গামা! আজি ইচ্ছে হয়েছে কইমাছ ভাজা খাবেন। কইমাছ জোগাড় না হওয়া পর্যন্ত খাওয়া বন্ধ। সবাই অতিষ্ঠ হয়ে উঠল।
শেষ পর্যন্ত পীর-ফকির ধরা হল। ধর্মনগরের সুফি সাহেবের পানিপড়া আনবার জন্যে আমি আর বাদশা মামা নৌকা করে ধর্মনগর রওনা হলাম। দু’দিনের পথ। উজান ঠেলে যেতে হয়। সঙ্গে চাল ডাল নিয়ে নিয়েছি। নৌকাতেই খাওয়া-দাওয়া। বাদশা মামা এই দীর্ঘ সময় চুপচাপ কাটালেন। সন্ধ্যার পর নৌকার ছাদে উঠে বসেন। নেমে আসেন। অনেক রাতে। সারাদিন শুয়ে শুয়ে ঘুমান। দেখলেই বোঝা যায়। ভরসা হারানো মানুষ। কিন্তু কী জন্যে ভরসা হারিয়েছেন তা বুঝতে না পেরে আমার খারাপ লাগে।
সপ্তম দিনে ফিরলাম। সুফি সাহেব খুব খাতির-যত্ন করলেন আমাদের। তাঁর অনুরোধে বাড়িতে চারদিন থেকে যেতে হল। কথা নেই বার্তা নেই, বাদশা মামা সুফি সাহেবের মুরিদ হয়ে গেলেন। মাথায় সব সময় টুপি, নিয়ম করে নামাজ পড়ছেন। যতই দেখি ততই অবাক হই।
আমার অবাক হওয়ার আরো কিছু বাকি ছিল। বাড়িতে ফিরে জানলাম, নকুমামা খুলনা জেলার মনোহরদীপুরে চলে যাচ্ছেন। কিছুদিন সেখানে থাকবেন। খুব স্বাস্থ্যকর জায়গা, শরীর ফিরলে চলে যাবেন রাজশাহী। নানাজানের খালাতো ভাই থাকেন সেখানে। সরকারি জরিপ বিভাগের কানুনগো। নবুমামা সেখানে থেকেই পড়াশুনা করবেন। নানাজান নিজে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়িতে তারই আয়োজন চলছে। নবুমামা আগের চেয়েও মিইয়ে গিয়েছেন। আমাকে ধরা গলায় বললেন, লাল ভাবীকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না।
আমি ভেবেই পেলাম না একা একা আমি কী কবে থাকব। নব্বুমামা আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। তাকে ছাড়া একা একা স্কুলে যাচ্ছি। এই দৃশ্য কল্পনা করলেও চোখে পানি এসে যায়। নবুমামার আমার জন্যে কোনো মাথাব্যথা নেই, তার মুখে শুধুই লাল ভাবীর কথা। আমি বললাম,
নবুমামা, আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে যান।
আমি কী করে নিয়ে যাব? তুই বাবাকে বল।
নানাজানকে বলবার সাহস আমার নেই। আমি লালমামিকে ধরলাম। মামি তখন বারান্দায় বসে সুচ-সুতো নিয়ে কী যেন করছিলেন। আমি কাঁদো-কাঁদো হয়ে সমস্ত খুলে বললাম। চুপ করে তিনি সমস্ত শুনলেন। আমার কথা শেষ হতেই বললেন, যা তো, দৌড়ে তোর ছোট খালার কাছ থেকে একটা সোনামুখী সুচ নিয়ে আয়। বলবি আমি চাইছি।
সুচ এনে দিয়ে আমার কাতর অনুরোধ জানালাম।
বলবেন তো মামি? আজই বলতে হবে। আজি সন্ধ্যা বেলাতেই।
মামি বিরক্ত হয়ে বললেন, কি ঘ্যান ঘ্যান করিস, পরের বাড়িতে আছিস যে কুঁশ নেই? ইচ্ছে হয় নিজে গিয়ে বল।
এর কিছুদিন পরই পানশী নৌকা করে নানাজান আর নবুমামা চলে গেলেন। যাবার সময় নবুমামার সে কী কান্না! কিছুতেই যাবে না। লালমামির শাড়ি চেপে ধরেছে। তারস্বরে চেঁচাচ্ছে, আমি যাব না, যাব না।
লালমামি শুকনো গলায় বললেন, শাড়ি ছাড়, শাড়ি ধরে চেঁচাচ্ছিস কেন?
নবুমামা চলে যাবার পর আমার কিছু করবার রইল না। আম-কঁঠালের ছুটি হয়ে গেছে স্কুল। সারাদিন বাড়িতে ঘুরে বেড়াই। বিকেল বেলাটা আর কিছুতেই কাটে না। রোদের তাপ একটু কমতেই হাঁটতে হাটতে চলে যাই সোনাখালী। হেঁটে যেতে যেতে কত আজগুবি চিন্তা মনে আসে। যেন কোন অপরাধ ছাড়াই দেশের রাজা আমাকে ধরে নিয়ে গিয়েছে। হুকুম হয়েছে, আমার ফাঁসি হবে। রাজ্যের সমস্ত লোক ফাঁসির মঞ্চের চারদিকে জড় হয়েছে। আমি তাকিয়ে দেখি, এদের মধ্যে লাল রঙের পোশাক পরা একটি মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলছে, না, এ ছেলে কোনো দোষ করেনি, এর ফাঁসি হবে না। বলতে বলতে মেয়েটি কেঁদে ফেলেছে। আমি বলছি, না, হোক, আমার ফাঁসি হোক। মেয়েটি অপলকে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার মুখের গড়ন অনেকটা লালমামির মত।
সোনাখালী পাকাপুলে অনেক রাত পর্যন্ত বসে থাকতাম। সেই সময় আমার মন থেকে ভূতের ভয় কেটে গিয়েছিল। একেক দিন নিশীথ রাতে একা এক ফিরেছি। অন্ধকারে একা ফিরতে ফিরতে কতবার চমকে উঠেছি নাম-না-জানা পাখির ডাকে। কিন্তু ভয় পাইনি কখনো। রান্নাঘরে গিয়ে দাঁড়ালেই মোহরের মা ভাত বেড়ে দেয়, নাও, খেয়ে গুণ্ঠী উদ্ধার কর। এইসব কথা কখনো গায়ে মাখি না।
আমি সে সময় অনেক বড়ো দুঃখে৷ ডুবে ছিলাম। ছোটখাটো কষ্টের ব্যাপার, যা প্রতিদিন ঘটত, এই নিয়ে সেই কারণেই কোনো মাথাব্যথা ছিল না।
দিন আর কাটতে চায় না কিছুতেই। স্নেহ, ভালবাসা ছাড়া কোনো মানুষই বাঁচতে পারে না। আমি সেই কারণেই হয়ত অসুস্থ হয়ে পড়লাম। শুয়ে শুয়ে সময় কাটাই। কেন জানি না, অসুখটাই ভাল লাগে। সকাল থেকে সন্ধা শুয়ে শুয়ে ঘুমানো ছাড়া অন্য কাজ নেই। মাঝে-মধ্যে বাদশামামা এসে বসেন। নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক কিছু কথাবার্তা হয়। মামা হয়ত বললেন,
বেশি করে দুধ খা, শরীরে জোর হবে।
আচ্ছা মামা, খাব।
পীরপুরে জন্মাষ্টমির মেলা, যাবি নাকি দেখতে?
অসুখ সারলে যাব।
মামা থাকেন অল্পক্ষণ। কথা বলেন ছাড়া-ছাড়া ভঙ্গিতে। দেখে-শুনে বড় অবাক লাগে। তাঁর স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে গেছে। গাল বসে গিয়ে কেমন প্রৌঢ় মানুষের মত দেখায়।
লালমামি বড়-একটা আসেন না। হয়ত দরজার বাইরে থেকে বললেন,
রঞ্জর জ্বর আবার এসেছে নাকি?
না মামি, জ্বর নেই।
না থাকলেই ভাল। এই বলে তিনি ব্যস্তভাবে চলে যান। তাঁর যাওয়ার পথে তৃষিত নয়নে তাকিয়ে থাকি। সে সময়ে লালমামিকে আমি একইসঙ্গে ভালবাসি আর ঘৃণাও করি। কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রতি এ ধরনের দ্বৈত অনুভূতি–সে-ই আমার প্রথম। পরবর্তী সময়ে অবশ্যি আরো অনেকের জন্যেই এমন হয়েছে।
ঠিক এ সময়ে আমার সফুরা খালার সঙ্গে অল্পমাত্রায় ঘনিষ্ঠতা হল। তাঁর সঙ্গে অন্তরঙ্গতা হবে এ আমার খুব ছোটবেলাকার বাসনা। তিনি আমার চেয়ে বছরখানেকের বড়ো হবেন। খুব চুপচাপ ধরনের মানুষ। ছোটবেলা থেকেই দেখেছি, তিনি একা-একা হেঁটে বেড়াচ্ছেন বারান্দায়। হাতে একটা লাঠি। মাঝে মাঝে ঠক ঠক করে শব্দ করছে আর মুখে বলছেন, উড়ে গেল পাখি। প্রথমদিন এ রকম অদ্ভুত ব্যাপার দেখে আমি তো আকাশ থেকে পড়েছি! তিনি আমাকে দেখতে পাননি, কাজেই তিনি লাঠি হাতে ঠক ঠক করতে লাগলেন আর পাখি ওড়াতে লাগলেন। আমি যখন গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
খালা, কী করেন?
লজ্জায় খালার চোখে পানি এসে গেল। কোনো রকমে বললেন,
কিছু না, আমি খেলি। তারপরও খালাকে এমন অদ্ভুত খেলা খেলতে দেখেছি। লজ্জা পাবেন এই জন্যে আমি তার সামনে পড়িনি। তাঁর সঙ্গে ভাব করবার আমার খুব ইচ্ছে হত। কিন্তু তিনি আমাকে দেখলেই ভারি লজ্জা পেতেন।
অসুখের সময় প্রায়ই সফুরা খালা এসে দাঁড়াতেন আমার দরজায়। আমি ডাকতাম,
খালা, ভেতরে আসেন।
না, আমি এখানেই থাকি।
এই বলে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতেন দরজায়। অনেক রকম কথা হত তার সাথে। কী ধরনের কথা তা আজ আর মনে নেই, মনে আছে, খালা সারাক্ষণই মুখ টিপে টিপে হাসতেন।
খালা মাঝে-মাঝে অদ্ভুত সব গল্প করতেন।
একদিন এসে বললেন, কাল রাতে ভারি আশ্চর্য একটি ব্যাপার হয়েছে রঞ্জু। ঘুমিয়ে আছি, হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ মেলতেই দেখি একটি ফুটফুটে পরী আমার খাটে বসে আছে। আমি তো অবাক! তারপর পরীটি অনেক গল্প করল আমার সঙ্গে। ভোর হয়ে আসছে। যখন তখন সে বলল, আমি যাই। আমি বললাম, ও ভাই পরী, তোমার পাখায় একটু হাত দেব? সে বলল, দাও না। আমি পরীর পাখায় হাত বুলিয়ে দেখলাম, কী তুলতুলে পাখা। আর সেই থেকে আমার হাতে মিষ্টি গন্ধ। দেখি না শুঁকে।
আমি সফুরা খালার হাত শুকতেই বকুল ফুলের গন্ধ পেলাম। খালা হয়ত অনেকক্ষণ বকুল ফুলের মালা হাতে করে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তারই গন্ধ। সফুরা খালা সত্যি ভারি অদ্ভুত মেয়ে ছিল। এক রাতে ভারি আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে গেল। আমি লিলিকে স্বপ্নে দেখলাম। সে ঠিক আগেকার মত অভিভাবকসুলভ ভঙ্গি করে বলছে, রঞ্জু, তোর একটুও যত্ন হচ্ছে না। এখানে। তুই আমার কাছে চলে আয়।
আমি লিলির কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। কত দিন হয়েছে সে চলে গেছে। এ দীর্ঘদিনেও তার কথা কেন যে মনে পড়ল না! স্বপ্ন ভেঙে আমার খুব অবাক লাগল। লিলি যে দেখতে কেমন ছিল তাও পৰ্যন্ত আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে, তার চিবুকটা লম্বাটে ধরনের ছিল। সেখানে একটা লাল রঙ্গের তিল ছিল। লিলি ছোটবেলায় আমাকে এই তিল দেখিয়ে বলত, রঞ্জু, এই তিলটিা যদি কপালে থাকত, তাহলে আমি রাজরানী হতাম।
দীর্ঘদিন পর লিলিকে স্বপ্নে নিখুঁতভাবে দেখলাম। এবং সে রাতেই ঠিক করলাম, ঘুম ভাঙতেই নানাজানের কাছ থেকে ঠিকানা জেনে লিলিকে চিঠি দেব। এই মনে করে আমার খুব ভাল লাগতে লাগল। মনে হল শরীর সেরে গেছে, একটু বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাওয়া খাই।
বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই জোছনা দেখে চোখ ছলছলিয়ে উঠল। এমন উথাল-পাথাল আলো দেখলে মানুষের মনে এত দুঃখ আসে। কেন কে জানে?
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম সেখানে। পা যখন ধরে এলো তখন দেয়াল ঘেঁষে বসে রইলাম। হঠাৎ শুনি পাশের ঘরে লালমামি কাঁদছেন।
কোনো ভুল নেই, স্পষ্ট শুনতে পেলাম। মামাও যেন নিচু গলায় কি একটা বললেন। মামি কান্না থামিয়ে ধমকে উঠলেন, কোনো কথা শুনব না। আমি।
বাইরের এই অপূর্ব জোছনার সঙ্গে এই ঘটনা কেমন যেন মিশ খায় না। আমার মন খারাপ হয়ে গেল।
চলবে,,,,,,,,,,,,,


.png)
No comments