"আম্মুর কান্নার শব্দ" একটি অন্যরকম জীবনের গল্প। @মিঃ মধু
"আম্মুর কান্নার শব্দ"
একটি অন্যরকম জীবনের গল্প
একটি অন্যরকম জীবনের গল্প।
আম্মুর কান্নার শব্দ।
প্রায় প্রতিদিনই সেহরিতে আমার ঘুম ভাঙতো কান্নার শব্দে! আম্মুর কান্নার শব্দে। আম্মু আমার রুমে এসে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন। তারপর মোনাজাতে কাঁদতেন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না! কী মায়া সেই কান্নায়! কাঁদবেন বলেই হয়তো আমার রুমে আসতেন। আব্বুর ঘুম ভাঙাতে চাইতেন না।
আমার রুম বললেও আসলে ভুল হবে। তখন আমার নিজের কোনো রুম ছিলো না।
আমাদের ড্রইংরুমে একটা বেড ছিলো,
সেখানেই আমি ঘুমাতাম।
প্রচন্ড ঠান্ডায় অন্ধকার রুমে সাদা ধবধবে লেপের নিচে শুয়ে শুয়ে আমি বোকার মতো আম্মুর কান্না শুনতাম।
আম্মু মোনাজাতে কী বলছেন বোঝার চেষ্টা করতাম। কিন্তু শুধু 'ইয়া আল্লাহ... ইয়া মাবুদ...' ছাড়া কিছুই বুঝতে পারতাম না! আল্লাহর কাছে আম্মুর কী অনুনয়! কী বিনয়! কী আকুতি! সেই মোনাজাতে এতো দরদ থাকতো আমি কিছু না বুঝেও মন খারাপ করতাম! বুকটা ফাঁকা হয়ে যেতো!
মনে মনে ভাবতাম আহা আম্মুর এতো কষ্ট?! আম্মু এতো কাঁদে!
আচ্ছা, আমি কেনো এভাবে মোনাজাতে কাঁদতে পারি না!? নিজেকে নিজে বুঝাতাম মনে হয় আমি ছোটো মানুষ তাই! বড়ো হলে নিশ্চয়ই আমিও আম্মুর মতো কাঁদতে পারবো! আম্মুকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য উঠবো কি না, আম্মুর কাছে যেয়ে বসবো কি না এসব ভাবতে ভাবতে আম্মুর ডাক পড়তো 'ওঠো আম্মু! সেহরির সময় হয়ে গেছে।"
আশেপাশের মসজিদ থেকে মাইকে শোনা যেতো "তাড়াতাড়ি উঠি যাউক্কা (তাড়াতাড়ি উঠে যান), আর মাত্র ত্রিশ মিনিট বাকী!" তাও উঠতাম না।
ক্লাস থ্রিতে পড়া ছোটো ভাই মাঝে মাঝে আমার সাথে ঘুমাতো।
আমি লেপটা আরো শক্ত করে ছোটো ভাইকে পেঁচিয়ে দিতাম!
এতো হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ছিলো তখন সিলেটে!
তারপর শুয়ে শুয়ে শুনতাম আব্বু উঠেছেন, আব্বুকে ওযুর জন্য গরম পানি দেওয়া হচ্ছে,
কিন্তু আব্বু বার বার লজ্জিত স্বরে বলছে না না আমি নিজেই নিয়ে নিবো! ওযু শেষে গামছা খুঁজছেন।
আমার আব্বু কখনো তোয়ালে ব্যবহার করতেন না। তাঁর সেই বিখ্যাত পাবনা বা কুষ্টিয়ার সুতি গামছাই ছিলো নিত্যসংগী। রান্নাঘর থেকে খুটখুট শব্দ আসছে। আম্মু আমাদের মোর্শেদাকে বলছে জগে কুসুম কুসুম গরম পানি ভরাতে, টেবিলটা একটু মুছে দিতে, গতরাতের তরকারিটা গরম করতে...।
ভাগ্যিস ঐ সময় আমার ফোন ছিলো না। তা না হলে এসব কিছুই শোনা হতো না, শুয়ে শুয়ে ফোন টিপতাম! আর আম্মু এসে নির্ঘাত চিল্লাচিল্লা শুরু করে দিতো 'সেহরীতে উঠেও ফোন! খেতে আসো!"
সবশেষে আব্বু আসতেন ডাকতে। 'কাব্যমনি আসো!' আব্বু ডাকা মানেই ফাইনাল ডাক।
এখন আর শুয়ে থাকা যাবে না। আমার উঠতে হবে! মাইকে শুনছি আর মাত্র পনেরো মিনিট বাকী! ঠান্ডায় উঠতে কষ্ট হতো আব্বু বুঝতেন। "লেপ দিয়ে বালিশ পর্যন্ত ঢেকে রাখো তাহলে তোমার বিছানা আর ঠান্ডা হবে না! -আব্বুর টিপস!
রানীর মতো বিছানা থেকে উঠতাম। কোনো দায় নাই, দায়িত্ব নাই! সব রেডিমেট! যেয়ে খালি খাবো।
ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে হাতের কাছে চাদর কিংবা একটা দু'টা সোয়েটার গায়ে জড়িয়ে খেতে বসতাম।
আমরা না আসলে আব্বু কখনো শুরু করতেন না। খাওয়ার সময় আব্বু শুধু আমার দিকে গরম পানি এগিয়ে দিতেন। আমি একদমই খেতে চাইতাম না। গরম পানি খেতে আমার একদমই ভালো লাগতো না।
আব্বু বুঝাতেন গরম না তো, এটা 'ওয়ার্ম ওয়াটার'! মনে মনে বলতাম ঐ একই কথা তো আব্বু!
আমরা তিনজন মিলে সেহরি করতাম। আমার ছোটোভাই তখনো সব রোজা করতো না। ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়তো, সারা বছর অসুস্থ থাকতো। তাই তার বিশেষ ছাড়! আম্মু তাঁর ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে আমাদের সাথে বসতেন কিন্তু কখনো খেতেন না। আম্মুর কাজই ছিলো 'কাব্য, আরেকটু ভাত নাও!, "কাব্যর আব্বু দুধ -ভাত খাবে?", "এই মোর্শেদা আরেক পিছ মাছ নিয়ে যা".... সবার শেষে আম্মু দুই গ্লাস পানি খেতেন।
আর যদি বাসায় দই থাকতো খুব বেশি হলে দুই চামচ দই খেতেন। এটাই ওনার সেহরি।
আম্মু সেহরিতে কখনো খেতে পারেন না।
আমি আড়চোখে আম্মুকে দেখতাম কে বলবে এই মহিলা এতোক্ষন মোনাজাতে কেঁদেছেন। আম্মু কাঁদলেই চোখ ফুলে গোল্লা গোল্লা হয়ে যেতো, নাক গাল লাল হয়ে যায়! মানুষ বুঝতো। আমার আবার ম্যালা দু:খ ছিলো! কারন আমি কাঁদলে আমার চোখ ফুলতো না, নাক লাল হতো না! কেউ যদি বুঝতেই না পারলো আমি কেঁদেছি তাহলে এই জীবনে কেঁদে কী লাভ, বলেন!?
মাঝে মাঝে আমার ভাই সেহরির শেষ দিকে টর্নেডোর গতিতে হামলা দিতো- 'আমাকে কেনো তোমরা ডাকলা না!? আমি রোজা রাখবো!" বলেই কান্না! দেখা গেল আযান দিয়ে দিয়েছে সেই কখন আর আম্মু কাতিবকে দুধ ভাত খাওয়ায় দিচ্ছেন, ভাইয়ের সেহরি! ও একটা কথা, দুধ-ভাত কিন্তু আমাদের বাসায় সুপার হিট খাবার ছিলো! আব্বু, আমার ছোটো ভাই, আমার পছন্দের খাবার। আর শুধু দুধ-ভাত হলেই হতো না একটা কলা থাকা ছিল মাস্ট! কলা না থাকলে দুধ-ভাত খাওয়া ক্যান্সেল।
সারাদিন শেষে আমরা আবার সবাই ইফতার করতে বসতাম। আযানের ৫/৭ মিনিট আগে আমাদের রুলস ছিলো মোনাজাত করার। কোনোদিন আব্বু করতেন, কোনোদিন আম্মু। কিন্তু আব্বু সবসময়ই আম্মুকে বলতেন তুমি সুন্দর করে বলো, তুমিই করো!
আমিও কয়েকদিন করেছি। কিন্তু লজ্জায় আল্লাহর কাছে কী চাই সবাইকে শোনাতে চাইতাম না!
আমার সবসময় একটাই চাওয়া ছিলো -আল্লাহ আমি যেনো এবার পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারি! আব্বু-আম্মুকে যেনো অনেক খুশি করতে পারি! যেহেতু তখন বেশিরভাগ রোজার আগেই বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হয়ে যেতো তাই পুরা রোজা জুড়ে আমার কমন দোয়া এটাই ছিল! আমার ছোটোভাই তখনও বিশেষ মূল্যহ্রাসে ছিলো! তাকে হাজার চেষ্টা করেও কেউ মোনাজাত ধরাতে পারেনি।
আব্বু-আম্মু দুজনই সাহিত্যের মানুষ। মোনজাতও সেইভাবে করতেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনতাম!
এতো সুন্দর সুন্দর কথা আব্বু -আম্মু বলতেন আমরা শুধু আমীন আমীন বলতাম। মনে হতো এই মোনাজাত অনন্তকাল চললেও আমরা ইফতার সামনে নিয়ে বসে থাকবো...!
দাদা-দাদি, নানা-নানিসহ আমাদের পূর্বপুরুষ, আত্নীয়-স্বজন, পাড়া- প্রতিবেশি, বন্ধু-বান্ধবী- কলিগ থেকে শুরু করে দেশের - বিদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ইহকাল, পরকাল কোনো বিষয়ই বাদ যেতো না। আমি মনে মনে ভাবতাম মোনাজাতে এতো কিছু কীভাবে মনে রাখেন!
আমার আম্মু ভীষন আবেগপ্রবণ, আবার কাঁদতেন... কিন্তু এই কান্না সেই শেষরাতের কান্নার মতো হতো না... এই কান্না আমরা সবাই শুনতাম কিন্তু শেষরাতের সেই কান্না শুধু উপরওয়ালাই জানতেন...।
আজ এতো বছর পর কতো কিছুই বদলে গেছে...।
বিয়ে হয়েছে, মা হয়েছি। সেহরিতে সবার আগে উঠি, তারপর সবাইকে ডাকি।
এখন আর বিছানায় অলসতায় উঠি উঠি করি না,
মাইকে বলতেও শুনি না 'তাড়াতাড়ি উঠি যাউক্কা আর পনেরো মিনিট বাকী!"
প্রতিদিন চোখে ভাসে ঐ যে আম্মু তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছেন আবার মনে হয় আম্মুর কান্নার শব্দ শুনছি...। আমাদের সিলেটের টিলাগড়ের সেই ছোট্ট বাসাটা, যে বাসায় নিজের কোনো রুম ছিলো না...
কিন্তু কী শান্তি ছিলো... সেহরিতে ওযুর পানি নিয়ে আব্বুর বিনয়ী কণ্ঠস্বর...
সেহরিতে না ডাকায় ছোটোভাইয়ের গগনবিদারী কান্না... বুকটা ভারী হয়ে আসে...
শেষ রাতে কীসের যেনো হাহাকারে নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হয়... ।
চারিদিকে শূন্যতা আর শূন্যতা...।
আবিষ্কার করি, আমি আসলেই অনেক বড়ো হয়ে গেছি -
তাই আজ আমিও আম্মুর মতো না হলেও মোনাজাতে অনেক কাঁদতে পারি...
লেখায়ঃ------
খাদিজা তুল কোবরা কাব্য
১২ এপ্রিল, ২০২২
১২ এপ্রিল, ২০২২
No comments