নারসিসিজম অর্থ স্বকাম, নারসিসিস্ট অর্থ স্বকামী ব্যক্তি, যাদের নিজের প্রতি থাকে অতিরিক্ত ভালোবাসা, এটি এক ধরনের পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার। ব্যক্তিত্ব সমস্যা বা পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার একটি মনোরোগ। এই রোগের কারণে মানুষ নিজের ক্ষতি তো করেই, সামাজিক নিয়ম-কাননের বাইরে এমন কিছু করে, যা অনেক বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
ওরা নিশ্চিন্তে অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে ট্র্যাফিক নিয়ম ভাঙতে পারে বা অন্য সামাজিক নিয়ম ভাঙতেও দ্বিধাবোধ করে না, এতে করে নিজের তো বটেই, অন্যেরও বড় কোনো ক্ষতি হতে পারে। এক সময় অসামাজিক হয়ে পড়ে এবং নিজের কাজের দক্ষতাও হারিয়ে ফেলতে পারে। পরিচয় সংকট (আইডেন্টিটি ক্রাইসিস) থেকে শুরু করে বহুমুখী পরিচয় সংকটে (মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার) ভুগতে পারে।
অনেক সময় নিজের কাজ, চিন্তা-চেতনা, স্মৃতি, পরিচয় সবকিছু মিলিয়ে ফেলে দ্বৈত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করতে থাকে। এদের ভেতরের যন্ত্রণা বাইরে থেকে কেউ দেখতে পায় না; কারণ এরা অতিরিক্ত অহঙ্কার এবং দাম্ভিকতার আড়ালে তা লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।
নারসিসিস্ট শব্দটা এসেছে গ্রিক পুরাণিকের একটি চরিত্র 'নারসিসাস' থেকে। খুব সুদর্শন এবং অহঙ্কারী শিকারি নারসিসাস একদিন হরিণ শিকার করতে গিয়েছিলেন। এ সময় নারসিসাসের খুব তৃষ্ণা পেলে ঝর্ণার ধারে যায় পানি পান করতে। ঝর্ণার স্বচ্ছ পানিতে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে সে এমনই মুগ্ধ হয় যে, নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যায়, বুঝতে পারেনি যে ওটা ওর নিজেরই প্রতিবিম্ব।
এরপর যতবার সে তার ভালোবাসাকে অর্থাৎ নিজেকে চুম্বন দিতে যায়, পানির কাছে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই প্রতিবিম্ব অদৃশ্য হয়ে যায়। পানি আর পান করতে পারে না। এদিকে নারসিসাসের তৃষ্ণা বাড়তেই থাকে; কিন্তু কোনোভাবেই পানি ছুঁয়ে দেখতেও সাহস পায় না আবার ওখান থেকে সরেও যেতে পারে না। ভয় পায় যে, ও সরে গেলে বা পানি ছুঁয়ে দিলে ওর প্রতিবিম্ব অর্থাৎ ওর ভালোবাসা হারিয়ে যাবে। এমন করতে করতেই একদিন নিজের প্রতি ভালোবাসার জন্য, তৃষ্ণায় কাতর হয়ে পানির অভাবে নারসিসাস মারা যায়।
এই গ্রিক পুরাণিক গল্পটা কাল্পনিক হতে পারে, চরিত্রগুলো কাল্পনিক হতে পারে কিন্তু এ রকম চরিত্রের প্রতিফলন আমরা সমাজের সর্বক্ষেত্রেই দেখা যায়। পৃথিবীজুড়ে নারসিসিস্টের কোনো অভাব নেই। সেই কারণেই এই নারসিসাস শব্দ থেকেই উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে নারসিসিজম শব্দটি, যা এই মানসিক সমস্যাটিকে শনাক্ত করার জন্য ব্যবহার করা হয়। এই পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার আসলে কেমন?
যাদের এই পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার আছে ওরা বিশ্বাস করে তারাই সমাজের বিশিষ্ট এবং শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তাই সমাজের অন্যান্য বিশিষ্ট মানুষও শুধু তাদের সঙ্গেই মিশতে পছন্দ করে, যারা অনন্য বা অদ্বিতীয় কিংবা কোনো না কোনোভাবে বিশেষ কোনো যোগ্যতার অধিকারী। এ
সব মানুষের সঙ্গই ওদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। এই আত্মবিশ্বাস বাইরে থেকে যত শক্তিশালীই দেখাক না কেন, এর ভেতরে সাধারণত লুকিয়ে থাকে এক ধরনের দুর্বল বা ঠুনকো বিশ্বাস।
যাদের এই মানসিক অবস্থা থাকে তারা অতিরিক্ত পরিমাণে তারিফ পেতে পছন্দ করে। কারণ ওদের সব সময় জানতে হয় যে, অন্যরা ওদের সম্পর্কে অত্যন্ত উচ্চ ধারণা পোষণ করে। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষকে সাধারণত উদগ্র, অহঙ্কারী এবং স্বার্থপর হতে দেখা যায়। ওদের চাহিদা খুব বেশি থাকে এবং ওরা খুব ম্যানিপিউলেটিভ হয়। মানুষকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কিছু বলে কিংবা ভয় দেখিয়ে ওদের কার্যসিদ্ধ করে থাকে।
মনোবিজ্ঞানী ব্র্যাড বুশম্যান বলেছেন, এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের যদি নারসিসিস্ট বলে চিহ্নিত করা হয় ওরা সেটাতে গর্ববোধ করে এবং মনে করে এমনই হওয়া উচিত, এটাই যথার্থ। ওদের মধ্যে অন্যের জন্য খুব একটা সহানুভূতি দেখা যায় না; তবে মানুষের প্রশংসা পাওয়া যাবে বলে ওরা ডোনেশন দিতে অনুপ্রাণিত হন।
কেন এই ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত হয়, তা এখনও পরিস্কার না। তবে ধারণা করা হয়, কেউ কেউ বংশগতভাবে এই অভ্যাস পেয়ে থাকে, ছোটবেলা থেকে এসব দেখে বড় হয়েছে এমনও হতে পারে, জৈবিক কারণে, জীবনের অভিজ্ঞতা বা পরিবেশ মানুষকে এই অবস্থানে উপনীত করতে পারে অনেক সময়।
ছোট বেলায় বাবা-মায়ের কাছে সব সময় শুধু ভালো রেজাল্ট বা ভালো কিছু করলেই ভালোবাসা পেয়েছে না হলে নয়, এমন পরিবেশে বড় হলেও এই ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে।
তীব্র হিংসা বোধ এবং খুব গভীর নিরাপত্তাহীনতায় ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে এই মনোভাবের শুরু হয় বলে ধারণা করেন অনেক মনোবিজ্ঞানী। অর্থাৎ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস; কিন্তু ভেতরে ভুগছেন প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায়।
ধন্যবাদান্তেঃ---"মিঃ মধু" আরও বিস্তারিত জানতে চেক করুন "অদৃশ্য কাব্য" মঞ্চ।
No comments