হুমায়ূন আহমেদ এর উপন্যাস "অচিনপুর" প্রথম-পর্ব । @মিঃ মধু
---অচিনপুর---
(প্রথম-পর্ব)
মরবার পর কী হয়?
আট-ন বছর বয়সে এর উত্তর জানবার ইচ্ছে হল। কোনো গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে চিন্তার বয়স সেটি ছিল না,
কিন্তু সত্যি সত্যি সেই সময়ে আমি মৃত্যু রহস্য নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েছিলাম।
সন্ধ্যাবেলা নবুমামাকে নিয়ে গা ধুতে গিয়েছি পুকুরে। চারদিক ঝাপসা করে অন্ধকার নামছে।
সন্ধ্যাবেলা নবুমামাকে নিয়ে গা ধুতে গিয়েছি পুকুরে। চারদিক ঝাপসা করে অন্ধকার নামছে।
এমন সময় হঠাৎ করেই আমার জানিবার ইচ্ছে হল, মরবার পর কী হয়? আমি ফিসফিস করে ডাকলাম,
নবুমামা, নবুমামা!
নবুমামা সাঁতরে মাঝ-পুকুরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি আমার কথা শুনতে পেলেন না।
নবুমামা, নবুমামা!
নবুমামা সাঁতরে মাঝ-পুকুরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি আমার কথা শুনতে পেলেন না।
আমি আবার ডাকলাম, নবুমামা, রাত হয়ে যাচ্ছে।
আর একটু ভয় লাগছে আমার।
একা একা পাড়ে বসে থাকতে সত্যি আমার ভয় লাগছিল। নবুমামা উঠে আসতেই বললাম, মরবার পর কি হয় মামা? নবুমামা রেগে গিয়ে বললেন, সন্ধ্যবেলা কী বাজে কথা বলিস? নবুমামা ভীষণ ভীতু ছিলেন, আমার কথা শুনে তাঁর ভয় ধরে গেল। সে সন্ধ্যায় দুজনে চুপি-চুপি ফিরে চলেছি। রাইসুদিন চাচার কবরের পাশ দিয়ে আসবার সময় দেখি, সেখানে কে দুটি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রেখে গেছে। দুটি লিকলিকে ধোয়ার শিখা উড়ছে সেখান থেকে। ভয় পেয়ে নবুমামা আমার হাত চেপে ধরলেন।
শৈশবের এই অতি সামান্য ঘটনাটি আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে। পরিণত বয়সে এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ছোট একটি ছেলে মৃত্যুর কথা মনে করে একা কষ্ট পাচ্ছে। এ ভাবতেও আমার খারাপ লাগত।
সত্যি তো, সামান্য কোনো ব্যাপার নিয়ে ভাববার মত মানসিক প্রস্তুতিও যার নেই, সে কেন কবরে ধূপের শিখা দেখে আবেগে টলমল করবে? কেন সে একা একা চলে যাবে সোনাখালি? সোনাখালির খালের বাধানো পুলের উপর বসে থাকতে থাকতে এক সময় তার কাঁদতে ইচ্ছে হবে?
আসলে আমি মানুষ হয়েছি। অদ্ভুত পরিবেশে। প্রকাণ্ড একটি বাড়ির অগুণতি রহস্যময় কোঠা। বাড়ির পেছনে জড়াজড়ি করা বাঁশবন। দিন-মানেই শেয়াল ডাকছে চারিদিকে। সন্ধ্যা হব-হব সময়ে বাশবনের এখানে-ওখানে জ্বলে উঠছে ভূতের আগুন। দোতলার বারান্দায় পা ছড়িয়ে বিচিত্র সুরে কোরান পড়তে শুরু করছে কানাবিবি। সমস্তই অবিমিশ্র ভয়ের।
আবছা অন্ধকারে কানাবিবির দুলে দুলে কোরান পাঠ শুনলেই বুকের ভেতর ধঙ্ক করে উঠত। নানিজান বলতেন, কানার কাছে এখন কেউ যেয়ো না গো। শুধু কানাবিবির কাছেই নয়, মোহরের মা পা ধোয়াতে এসে বলত, পুলাপান কুয়াতলায় কেউ যেও না। কুয়াতলায় সন্ধ্যাবেলায় কেউ যেতাম না। সেখানে খুব-একটা ভয়ের ব্যাপার ছিল। ওখানে সন্ধ্যাবেলায় যেতে নেই।
চারিদিকেই ভয়ের আবহাওয়া। নানিজানের মেজাজ ভাল থাকলে গল্প ফাঁদতেন। সেও ভূতের গল্প : হাট থেকে শোল মাছ কিনে ফিরছেন তার চাচা। চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি পড়ছে। টিপ টপ। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেছেন, ওমনি পেছন থেকে নাকিসুরে কে চেঁচিয়ে উঠলো, মাঁছটা আঁমারে দিঁয়ে যাঁ।
রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের জাগিয়ে এনে ভাত খাওয়াত মোহরের মা। লম্বা পাটিতে সারি সারি থালা পড়ত। ঘুম-ঘুম চোখে ভাত মাখাচ্ছি, এমন সময় হয়ত ঝুপ করে শব্দ হল বাড়ির পেছনে। মোহরের মা খসখসে গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
পেততুনি নাকি? পেততুনি নাকি রে?
নবুমামা প্রায় আমার গায়ের উপর হুমাড়ি খেয়ে চাপা সুরে বলত, ভয় পাচ্ছি, ও মোহরের মা, আমার ভয় লাগছে।
নানাজানের সেই প্রাচীন বাড়িতে যা ছিল সমস্তই রক্ত জমাট-করা ভয়ের। কানাবিবি তার একটি মাত্র তীক্ষা চোখে কেমন করেই-না তাকাত আমাদের দিকে। নবুমামা ধলত, ঐ বুড়ি আমার দিকে তাকালে কঞ্চি দিয়ে চোখ গেলে দেব। কানাবিবি কিছু না বলে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসত। মাঝেমধ্যে বলত, পুলাপান ডরাও কেন? আমি কিতা? পেত্নী? পেত্নী না হয়েও সে আমাদের কাছে অনেক বেশি ভয়াবহ ছিল; শুধু আমরা নাই, বড়রা ও তাকে সমীহ করে চলতেন! আব্বা সমীহ করবে নাই-বা কেন? বড় নানিজানেবা নিজের মুখ থেকে শোনা গল্প।
তার বাপের দেশের মেয়ে কানাবিবি। বিয়ের সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। ফাই-ফরমাস খাটে। হেসে-খেলে বেড়ায়। একদিন দুপুরে সে পেটের ব্যথায় মরো-মরো। কিছুতেই কিছু হয় না, এখন-যায় তখন-যায় অবস্থা। নানাজান লোক পাঠিয়েছেন। আশু কবিবাজকে আনতে। আশু কবিরাজ এসে দেখে সব শেষ। বরফের মত ঠাণ্ডা শরীর; খাটিয়ায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁশ কাটতে লোক গেল। নানিজান মরার মাথার কাছে বসে কোরান পড়তে লাগলেন। অদ্ভূত ব্যাপারটা ঘটল ঠিক তখনই–আমার নানিজান ভয়ে ফিট হয়ে গেলেন। নানাজান আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ! কারণ কানাবিবি সে সময়ে ভাল মানুষের মত উঠে বসে পানি খেতে চাচ্ছে। এর পর থেকে স্বভাব-চরিত্রেব আমল পবিবর্তন হল তার। দিনরাত নামাজ-রোজা। আমরা যখন কিছু কিছু জিনিস বুঝতে শিখেছি, তখন থেকে দেখছি, সে পাড়ার মেয়েদের তাবিজকবজ দিচ্ছে; সন্ধ্যা হতে-না-হতেই দোতলার বারান্দায় কুপি জ্বালিয়ে বিচিত্র সুরে কোরান পড়ছে। ভয় তাকে পাবে না কেন?
এ তো গেল রাতের ব্যাপার। দিনের বোলা ও কি নিস্তার আছে? গোল্লা ছুটি খেলতে গিয়ে যদি ভুলে কখনো পূর্বের ঘরের কাছাকাছি চলে গিয়েছি, ওমনি রহমত মিয়া বাঘের মতন গর্জন কলে উঠেছে, খাইয়া ফেলুম। ঐ পোলা, কাঁচা খাইয়া ফেলামু; কচ কচ কচ। ভয়ানক জোয়ান একটা পুরুষ শিকল দিয়ে বাঁধা, ব্যাপারটা ভয়াবহ। বদ্ধ পাগল ছিল রহমত মিয়া, নানাজানের নৌকার মাঝি। তিনি রহমতকে স্নেহ করতেন খুব, সারিয়ে তুলতে চেষ্টা ও করেছিলেন। লাভ হয়নি।
এ সমস্ত মিলিয়ে তৈরি হয়েছে আমার শৈশব। গাঢ় রহস্যের মত ঘিরে রয়েছে আমার চারদিক। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, অল্প বয়সের ভয়-কাতর একটি ছেলে তার নিত্যসঙ্গী নবুমামার হাত ধরে ঘুমুতে যাচ্ছে, দোতলার ঘরে। নবুমামা বলছেন, তুই ভিতরের জানালা দুটি বন্ধ করে আয়, আমি দাঁড়াচ্ছি বাইরে। আমি বলছি, আমার ভয় করছে, আপনি ও আসেন। মামা মুখ ভেংচে বলছেন, এতেই ভয় ধরে গেল! টেবিলে রাখা হ্যাঁরিকেন থেকে আবছা অ্যালো আসছে। আমি আর নবুমামা কুকুর-কুণ্ডুলি হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে গুয়ে আছি। নবুমামা শুতে-না-শুতেই ঘুম; একা একা ভয়ে আমার কান্না আসছে। এমন সময় বাড়ির ভেতব থেকে হৈচৈ শোনা গেল। শুনলাম, খড়ম পায়ে খটখট করে কে যেন এদিকে আসছে; মোহরের মা মিহি সুরে কাঁদছে, আমি অনেকক্ষণ সেই কান্না শুনে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। জানাতেও পারিনি সে-রাতে আমার মা মারা গিয়েছিলেন।
সে-রাতে আমার ঘুম ভেঙেছিল ফজরের নামাজের সময়। জেগে দেখি, বাদশা মামা চুপচাপ বসে আছেন চেয়ারে। আমাকে বললেন, আর ঘুমিয়ে কি কারবি, আয় বেড়াতে যাই। আমরা সোনাখালির খাল পর্যন্ত চলে গেলাম; সেখানে পাকা পুলের উপর দুজনে বসে বসে সূর্যোদয় দেখলাম। প্রচণ্ড শীত পড়েছিল সেবার। কুয়াশার চাদরে গাছপালা ঢাকা। সূর্যের আলো পড়ে শিশির-ভেজা পাতা চকচক করছে। কেমন অচেনা লাগছে সব কিছু। মামা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, রঞ্জু, আজ তোর খুব দুঃখেব দিন। দুঃখের দিনে কি করতে হয় জানিস?
না।
হা হা করে হাসতে হয়। হাসলেই আল্যা বলেন, একে দুঃখ দিয়ে কোনো লাভ নেই। একে সুখ দিতে হবে। বুঝেছিস?
বুঝেছি।
বেশ, তাহলে হাসি দে আমার সঙ্গে।
এই বলে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বাদশা মামার খুব মোটা গলা ছিল। তার হাসিতে চারদিক গম গম করতে লাগল। আমি ও তাঁর সঙ্গে গলা মিলালাম। বাদশা মামা বললেন, আজ আর বাসায় ফিরে কাজ নেই, চল শ্রীপুর যাই। সেখানে আজ যাত্রা হবে। আমি মহাখুশি হয়ে তাঁর সঙ্গে চললাম।
কতদিনকার কথা, কিন্তু সব যেন চোখের সামনে ভাসছে।
বাদশা মামার সঙ্গে আমার কখনো অন্তরঙ্গতা হয়নি। অথচ আমরা একই ঘরে থাকতাম। দোতলার সবচেয়ে দক্ষিণেব ঘরে দুটো খাটের একটিতে বাদশা মামা, অন্যটিতে আমি আর নবুমামা। সারাদিন বাদশা মামার দেখা নেই। রাতে কখন যে ফিরতেন, তা কোনোদিনই জানিনি। ঘুম ভাঙার আগে-আগেই চলে গেছেন। কোনো কোনো বাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছি গুনগুন করে কী পড়ছেন। যেদিন মেজাজ ভালো থাকত সেদিন খুশি-খুশি গলায় বলতেন, রঞ্জু, শুন তো দেখি, কেমন হচ্ছে বলবি। আমি হঠাৎ ঘুম-ভাঙা অবস্থায় কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। মামা দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলা শুরু করেছেন–
এ রাজ্যপাঠ যায় যাক,
কোনো ক্ষতি নেই
কিন্তু ত্ৰিদীব তুমি
কোথা যাবে?
ভরাট গলা ছিল তার, সমস্ত ঘর কোপে কেঁপে উঠত। মাঝপথে থেমে গিয়ে বলতেন, দাঁড়া, পোশাকটা পরে নেই, পোশাক ছাড়া ভাল হয় না। তোল, নবুকে ঘুম থেকে তোল। নবুমামার ঘুম ভাঙালেই প্রথম কিছুক্ষণ নাকি সুরে কাঁদত। বাদশা মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন,–গাধা! দেখ না কী করছি। তারপর দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি বাদশা মামার দিকে। আলমারি খুলে তিনি মুকুট বের করেছেন, জড়িদার পোশাক পরেছেন। তারপর একা একাই অভিনয় করে চলেছেন। আমরা দুই শিশু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি।
বাদশা মামা প্রথম থেকেই আমাদের কাছে দূরের মানুষ। যিনি জরির পোশাক পরে রাতদুপুরে আমাদের অভিনয় দেখান, তিনি কাছের মানুষ হতে পারেন না। বাড়ির মানুষের কাছেও তিনি দল-ছাড়া। খুব ছোটবেলায় নানাজান তাকে একবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। যে ছেলে স্কুল পালিয়ে যাত্ৰাদলে চলে যায়, নানাজানের মতো লোক তাকে ঘরে রাখতে পারেন না। খবর শুনে ছোট নানিজান খাওয়া-দাওয়া ছাড়লেন। মরো-মারো অবস্থা! নানাজান লোক পাঠিয়ে বাদশা মামাকে ফিরিয়ে আনলেন। সেই থেকে তিনি বাদশা মামাকে ঘাটান না! বাদশা মামাও আছেন আপন মনে।
বাদশা মামা আমার শিশুচিত্তকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিলেন। শিল্পীর সব সময়ই শিশুদের আকর্ষণ করে। হয়ত শিশুরাই প্রতিভার খবর পায় সবার আগে, কিন্তু বাদশা মামা দারুণ অসুখী ছিলেন। যে সামাজিক পদমর্যাদা তার ছিল তা নিয়ে যাত্ৰাদলের মানুষদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন না। অথচ তাঁর চিন্তা-ভাবনার সমস্ত জগৎ যাত্ৰাদলকে ঘিরে। মাঝে-মাঝেই তাঁকে দেখেছি, বারান্দায় চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে আছেন। যদি গিয়ে বলেছি,
মামা কি করেন?
কিছু না।
সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়েছে, মামা তেমনি বসেই আছেন। কেউ যদি গিয়ে বলেছে,
বাদশা, তোর কি হয়েছে রে?
কিছু না।
মাঝে-মাঝেই এ রকম হত তাঁর। নানাজান তখন ক্ষেপে যেতেন। ছোট নানিজনকে ডেকে বলতেন, ভং ধরেছে নাকি? শক্ত মুগুড় দিয়ে পিটালে ঠিক হয়, বুঝেছ? নানিজান মিনমিন করে কী কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করেন। তারপর একসময় দেখা যায়, তিনি বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছেন।
নানাজানকে সবাই ভয় করতাম আমরা। দোতলা থেকে একতলায় তিনি নেমে এলে একতলা নীরব হয়ে যেত। খুব কম বয়সী শিশু, যাদের এখনো বিচার-বুদ্ধিও হয়নি, তারাও নানাজানকে দেখলে ফ্যাকাসে হয়ে যেত। ভয়টাও বহুলাংশে সংক্ৰামক।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙত নানাজানের কোরান পাঠের শব্দে। মোটা গলা, টেনে টেনে একটু অনুনাসিক সুরে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। তখন মাথায় থাকত লাল রংয়ের ঝুটি ওয়ালা একটা ফেজ টুপি। খালি গা, পরনে সিন্ধের ধবধবে সাদা লুঙ্গি। হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ঝুকে ঝুকে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। পড়া শেষ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেন। ছোট নানিজান এই সময়ে জাম-বাটিতে বড় এক বাটি চা তৈরি করে নিয়ে যেতেন। নানাজান চুকচুক করে অনেকটা সময় নিয়ে চা খেতেন। তারপর নিজের হাতে হাঁসের খোয়াড় খুলে দিতেন। পাশেই মুরগির খোয়াড়, সেটিতে হাতও দিতেন না। হাঁসগুলি ছাড়া পেয়ে দৌড়ে যেত পুকুরের দিকে। তিনিও যেতেন পিছু পিছু। সমস্তই রুটিন বাধা, একচুলও এদিক-ওদিক হবার জো নেই।
কিছু কিছু মানুষ ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে, আবার কারো কারো কাছে ভাগ্য আপনি এসে ধরা দেয়। নানাজান এ দুটির কোনোটির মধ্যেই পড়েন না। পূৰ্বপুরুষের গড়ে যাওয়া সম্পদ ও সম্মানে লালিত হযেছেন। কিন্তু অসংযমী হননি। অহংকার ছিল খুব, সে অহংকার প্রকাশ পেত বিনয়ে। হয়ত কোনো আত্মীয়-কুটুম্ব এসেছে বেড়াতে; নানাজান ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বার বার বলছেন, গরিবের ঘরে এসেছেন, কী দিয়ে খেদমত করি, বড়ো সরমিন্দায় পড়লাম, বড়ো কষ্ট হল আপনার; ওরে তামুক আন, আর খাসি ধর দেখি একটা ভাল দেখে। যিনি এসেছেন, আয়োজনের বাহুল্য দেখে তিনি লজ্জায় পড়ে যেতেন।
পঁয়ত্ৰিশ বছর আগের দেখা চিত্র। স্মৃতি থেকে লিখছি। সে স্মৃতিকে বিশ্বাস করা চলে। আমরা যারা ছেলে-ছোকড়ার দলে, তাদের প্রতি নানাজানের কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একা একা থাকতেন। সারাক্ষণই। বড়ো নানিজান তো কিছু পরিমাণে অপ্রকৃতস্থই ছিলেন। তিনি দোতলা থেকে নামতেন। কালে-ভদ্রে। ছোট নানিজানও যে কখনো হালকা সুরে নানাজানের সঙ্গে আলাপ করছেন, এমন দেখিনি। খালারাও আমাদের মত দূরে দূরে থাকতেন। ক্ষমতাবান লোকরা সব সময়ই এমন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে যায়।
কেন জানি না, আমার নিজের খুব ইচ্ছে হত নানাজানের সঙ্গে ভাব করি। ঘুমোতে যাবার আগে কতদিন ভেবেছি, নানাজান যেন এসে আমাকে বলছেন, আয় রঞ্জু বেড়াতে যাই। আমি তার হাত ধরে চলেছি বেড়াতে। কতদিন ভেবেছি আজ ঘুম থেকে উঠেই নানাজানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।
কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। ঘুম ভাঙতেই তাড়া পড়েছে, ওজু করে পড়তে যা, ওজু করে পড়তে যা। মৌলভী সাহেব বসে আছেন বাইরের ঘরে। আমরা সবাই আমপারা হাতে করে একে একে হাজির হচ্ছি। মেয়েরা ডান পাশে, ছেলেরা বাঁপাশে। সমবেত কণ্ঠে অ্যাওয়াজ উঠছে, আলিফ দুই পেশ উন, বে দুই পেশ বুন। নাশতা তৈরি হওয়া মাত্র আরবি পড়া শেষ। তারপর ইংরেজি, বাংলা আর অংকের পড়া। পড়াতে আসতেন রাম মাস্টার। ভারি ভাল মাস্টার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। নবুমামা ছাড়া বনিয়েছিলেন–
রাম মাস্টার বুড়া
এক পা তার খোঁড়া
স্কুলে যাবার আগ পর্যন্ত পড়াতেন তিনি। তার কাছে পড়ত শুধু ছেলেরাই। মেয়েদের আরবি ছাড়া অন্য কিছু পড়বার প্রয়োজন ছিল না। তারা ঘরের কাজ করত, জরি দিয়ে লতা-পাতা ফুল বানাত, বালিশের ওয়াড়ে নকশা তুলে লিখত, ভুল না আমায়। রাম মাস্টার চলে যেতে যেতে স্কুলের বেলা হয়ে যেত। স্কুল শেষ হয়ে গেলে তো খেলারই পাঠ। সূর্য ডুবে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত চলত হৈ হৈ। ফুরসত ফেলার সময় নেই। এর মধ্যেই লিলি এসে আমাকে নিয়ে যেত বাড়ির ভেতর। সে নিজেকে সব সময় ভাবত আমার একজন অভিভাবক। সে যে আমার বড়বোন এবং নানাজানের এই প্রকাণ্ড বাড়িতে আমিই যে তার সবচেয়ে নিকটতম জন, তা জানাতে তার ভারি আগ্রহ ছিল।
শাড়ি-পরা তার হালকা-পাতলা শরীর কোনো ফাঁকে আমার নজরে পড়ে গেলেই মন খারাপ হয়ে যেত। অবধাবিতভাবে সে হাত ইশারা করে আমায় ডাকবে। ফিসফিস করে বলবে, কাল সবাই দুখান করে মাছ ভাজা খেয়েছে, আর তুই যে মোটে একটা নিলি।
একটাই তো দিয়েছে আমাকে।
বোকা কোথাকার। তুই চাইতে পারলি না? আর দুধ দেবার সময় বলতে পারিস না, আরেক হাতা দুধ দাও মোহরের মা?
দুধ ভাল লাগে না আমার।
ভাল না লাগলে হবে? স্বাস্থ্য ভাল করতে হবে না? বেকুব কোথাকাব।
এই বলে সে হয়ত কাঁচা-মিঠা গাছের আমি এনে দিল আমার জন্য। আবার কোনোদিন হয়ত ডেকে নিয়ে গেল বাড়ির পেছনে। আগের মতো গলা নেমে গেছে খাদে। ফিসফিস করে বলছে, কি ভাবিস তুই, আমরা কী ফ্যালনা? বড় নানীজানের সম্পত্তির অংশ পাব না। আমরা? নিশ্চয়ই পাব। বড় নানিজানের মেলা সম্পত্তি। আর আমাদের মা হচ্ছে তার একমাত্র মেয়ে। আমরা দুজনেই শুধু ওয়ারিশান। বুঝলি?
হ্যাঁ, বুঝেছি।
কাঁচকলাটা বুঝেছিস। হাদার বেহদ্দ তুই। ছিঃ ছিঃ, এতটুকু বুদ্ধিও নেই। নে, এটা রাখা তোর কাছে।
তাকিয়ে দেখলাম চকচকে সিকি একটা।
কই পেয়েছে?
আমার ছিল বলেই লিলি আবাব ফিসফিস করে বলল,
দেখিস আবার, গাধার মত সবাইকে বলে বেড়াবি না।
না, বলব না।
লিলিব ভাবভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, পয়সাটা অন্যভাবে জোগাড় করেছে সে। আমরা দুভাইবোন কখনো হাতে পয়সা পেয়েছি, এমন মনে পড়ে না। অল্প বয়সে স্নেহটাকে বন্ধন মনে হত না। চাইতেই যা পাওয়া যায় তা তো সব সময়ই মূল্যহীন।
লিলিকে ভাল লাগত কালে-ভদ্রে। যেদিন সে খেয়ালের বসে সামান্য সাজ করে লজ্জা-মেশানো গলায় আমাকে দোতলায় ডেকে নিয়ে যেত, সেদিন তাকে আমি সত্যি সত্যি ভালবাসতাম। কিংবা কে জানে অল্প বয়সেই হয়ত করুণা করতে শিখে গিয়েছিলাম। সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নাক-মুখ অল্প লাল করে বলত,
আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোকে সঙ্গে করে নিযে যাব, তুই থাকবি আমার সঙ্গে?
কবে বিয়ে?
হবে শিগগির।
তারপরই যেন নেহায়েত একটা কথার কথা এমনিভাবে বলে বসত, দেখ তো রঞ্জু, শাড়িতে আমাকে কেমন মানায়?
ভাল।
কিন্তু আমার নাকটা যে একটু থ্যাবড়া।
এ বাড়ির কাউকেই লিলি দেখতে পারত না। ভেবে পাই না কেমন কবে এত হিংসা পুষে সে বড় হয়েছে। আমি ছাড়া আর একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে তার অল্পবিস্তর খাতির ছিল। তিনি আমাদের বড় নানীজান। বড় নানীজান থাকতেন দোতলায় বাঁদিকের সবচেয়ে শেষের ঘরটায়। অন্ধকার ছোট একটি কুঠুরি। জানালার সামান্য যে ফাঁক দিয়ে আলো-বাতাস আসে, তাও গাবগাছের ঝাঁকড়া ডালপালা অন্ধকার করে রেখেছে। আলো-বাতাসহীন সেই অল্প পরিসর ঘরে বড় নানীজান রাতদিন বসে আছেন। দেখে মনে হবে, নানাজানের দেড়গুণ বেশি বয়স। সমস্ত মাথায় চুল পেকে ধবধব করছে। দাঁত পড়ে গাল বসে গেছে। নিচের মাড়িতে একটি মাত্র নোংরা হলুদ দাঁত। মাঝে-মধ্যে তিনি রেলিং ধরে কাঁপা কাঁপা পায়ে নিচে নেমে আসতেন। কি ফুর্তি তখন আমাদের! সবাই ভিড় করেছি তার চারপাশে। নানীজান মস্ত একটি মাটির গামলায় দুপয়সা দামের হলুদ রঙের হেনরী সাবান গুলে ফেনা তৈরি করেছেন। ফেনা তৈরি হলেই ঢালাও হুকুম—মুরগি ধইরা আন। মুরগি ধরে আনবার জন্য ছোটাছুটি পড়ে যেত আমাদের মধ্যে। সব মুরগি নয়, শুধু ধবধবে সাদা মুরগি ধরে আনবার পালা। নানীজান সেগুলিকে সাবান-গোলা পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করতেন। পাশেই বালতিতে নীল রঙ গোলা থাকত। ধোয়া হয়ে গেলেই নীল রঙ-এ চুবিয়ে ছেড়ে দেয়া। কি তুমুল উত্তেজনা আমাদের মধ্যে।
টগরের সঙ্গে যখন গল্প করলাম। সে নিচের ঠোট উল্টে দিয়ে বলল, এত মিথ্যে কথাও তোমার আসে? ছিঃ ছিঃ!
মিথ্যে নয় বলে তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। বড় নানীজনকে নিয়ে কত বিচিত্র সব গল্প আছে। তাঁর ভূতে পাওয়ার গল্পটিও আমি টগরকে শুনিয়েছিলাম।
বড় নানীজনের অভ্যোস ছিল, সন্ধ্যাবেল পুকুরে সাঁতার কেটে নাওয়া। তখন কার্তিক মাস। অল্প-অল্প হিম পড়েছে। নানীজান গিয়েছেন অভ্যেসমত গোসল সারাতে। সূর্য ডুবে অন্ধকার হল, তার ফিরবার নাম নেই। মোহরের মা হ্যাঁরিকেন জ্বালিয়ে পুকুরঘাটে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, কোমর-জলে দাঁড়িয়ে তিনি থর থর করে কাপছেন। মোহরের মা ভয় পেয়ে বলল, কি হয়েছে গো?
নানীজান অস্পষ্টভাবে টেনে টেনে বললেন, ও মোহরের মা, টেনে তোল আমাকে, আমি উঠতে পারি না, কত চেষ্টা করলাম উঠতে।
টগর বলল, হিস্টিরিয়া ছিল তোমার নানীর। ভূত-ফুত কিছু নয়। তোমার বড় নানীজানের। ছেলেমেয়ে হয়নি নিশ্চয়ই।
না, হিস্টিরিয়া ছিল না তার। আর ছেলেমেয়ে ছিল না, তাও নয়। বড় নানীজনের একটি মাত্র মেয়ে ছিল, হাসিনা। সবাই ডাকত হাসনা। তিনি আমার আর লিলির মা।
হাসনা তিন মাসের একটি শিশুকে কোলে করে আর চার বছরের একটি মেয়ের হাত ধরে এ বাড়িতে এসে উঠেছিল। কোনো একটি বিশেষ ঘটনার কাল্পনিক চিত্র যদি অসংখ্যাবার আঁকা যায়, তাহলে এমন একটি সময় আসে যখন সেই কাল্পনিক চিত্রকেই বাস্তব বলে ভ্রম হয়। আমি মাধ। এ বাড়িতে আসার ঘটনাটি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। প্রতিটি ডিটেল অত্যন্ত সূক্ষ্ম।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হ্যাঁরিকেন আর কুপি মিলিয়ে পনেরো-বিশটি বাতি জ্বলছে এখানেওখানে। বিল থেকে ধরে আনা মাছের গাদার চারপাশে বলে বউ-ঝিরা মাছ কুটিছেন আর হাসিতামাশা করছেন। হাসনা এল ঠিক এ সময়ে। অত্যন্ত জেদী ভঙ্গিতে সে উঠোনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখতে পেয়ে সবাই অবাক হয়ে নেমে এল উঠোনে। খড়ম খট খট করে নানাজান নেমে এলেন দোতলা থেকে আর হাসনা শুকনো চোখে দেখতে লাগল সবাইকে।
হাসনার বিয়েতে সারা গাঁর দাওয়াত ছিল। হিন্দুরা মুসলমান বাড়িতে এখন ইচ্ছে করে মাংস খেতে আসেন, তখন আসতেন না। হিন্দুদের জন্যে ঢালাও মিষ্টির ব্যবস্থা। নাম-করা কারিগর রমেশ ঠাকুর দু’দিন আগে বাড়িতে ভিয়েন বসালেন।
আত্মীয়-কুটুম্বের জায়গা হয় না ঘরে, নতুন ঘর উঠল এদিকে-ওদিকে। গাঁয়ের দারোগা খেতে এসে আঁৎকে উঠে বলল, করছেন কি খান সাহেব? এ যে রাজরাজাদের ব্যাপার! নানাজান হাসিমুখে বললেন, প্রথম মেয়ের বিয়ে, সবাইকে না বললে খারাপ দেখায়, সবাই আত্মীয়-স্বজন।
গ্রামের নিতান্ত গরিব চাষীও মেয়ের বিয়েতে দুবিঘা জমি বিক্রি করে ফেলে, হালের গুরু বেঁচে দেয়। আর নানাজান তখন টাকার উপর শুয়ে।
হাতি আনতে লোক গেল হালুয়াঘাট। সেখানে কালুশেখের দুটি মাদী হাতি আছে। বন থেকে–কাঠের বোঝা টেনে নামায়। বিয়ের আগের রাতে মাহুতকে ঘাড়ে করে মাতৃ এসে দাঁড়াল। উৎসাহী ছেলেমেয়েরা কলাগাছের পাহাড় বানিয়ে ফেলল উঠোনে। মাহুতের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলার জন্য কী আগ্রহ সবার। মাহুত সাহেব কী একটু তামাক খেতে ইচ্ছে করবেন?
হাতির পিঠে চড়ে বর এসে নামল। লোকে লোকারণ্য। ভিড়ের চাপে গেট ভেঙে পড়ে, এমন অবস্থা। জরীর মালায় বরের মুখ ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কলম পড়ানোর আগে জরীর মালা সরানো হবে না। সে-ও রাত একটার আগে নয়। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে বর বন্ধুদের নিয়ে সিগারেট খেতে গেল বাইরে। আমনি হৈ-হৈ করে উঠল। সবাই, দেখেছি! কী রঙ! যেন সাহেবদের রঙ। রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে যেন!
লিলিরও বিয়ে হল এই বাড়িতে। দশ-পনের জন বন্ধু নিয়ে রোগামত একটি ছেলে বসে রইল বাইরের ঘরে। নিতান্ত দায়সারা গোছের বিয়ে। ভাল ছেলে পাওয়া গেছে, এই তো ঢের। তাছাড়া গয়না-টয়নাও তো নেহায়েত কম দেওয়া হয়নি। মায়ের গলার হার, হাতের ছ’গাছা চুরি, নানীজান দিলেন কানের দুল, ছোট নানীজান নাম-লেখা আংটি। কবুল বলতে গিয়ে লিলি তবু কেঁদে-কেটে অস্থির। নানাজানের প্রবল ধমকের এক ফাঁকে কখন যে কবুল বলেছে তা শুনতেই পেল না কেউ।
ন’মাইল পালকি করে গিয়ে ট্রেন। ট্রেন পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে আসব আমি আর নবুমামা। বেডিংপত্তর নিয়ে দুজন কমলা আগে আগে চলে গিয়েছে। পালকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না, বারবার পিছিয়ে পড়ি। নবুমামা বললেন, পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, আমি জুতা খুলে ফেললাম।
সজনিতলা এসে পান্ধি থামল। বেহারারা জিরোবে। পান-তামুক খাবে। লিলি পালকির ফাঁক থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকল, এই রঞ্জু, দুষ্টামি করবি না তো?
না।
আমার জন্য কাঁদবি না তো?
না, কাঁদব না।
কাঁদবি না কী রে গাধা? বোনের জন্য না কাঁদলে কার জন্য কাঁদবি? আমার কী আর কেউ আছে?
ট্রেন ছেড়ে দিল।
এই বাড়ি ঐ বাড়ি করে ট্রেন দ্রুত সরে যাচ্ছে। নবুমামা কাঁদছেন হু হু করে। বেহার এসে বলল, দুজনে এসে বসেন পালকিতে, ফিরিয়ে নিয়ে যাই।
লিলিকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসে আমার বয়স যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল। মনে হল কিছু কিছু চিরন্তন রহস্য যেন বুঝতে পারছি।
চলবে,,,,,,,,,,,,
আর একটু ভয় লাগছে আমার।
একা একা পাড়ে বসে থাকতে সত্যি আমার ভয় লাগছিল। নবুমামা উঠে আসতেই বললাম, মরবার পর কি হয় মামা? নবুমামা রেগে গিয়ে বললেন, সন্ধ্যবেলা কী বাজে কথা বলিস? নবুমামা ভীষণ ভীতু ছিলেন, আমার কথা শুনে তাঁর ভয় ধরে গেল। সে সন্ধ্যায় দুজনে চুপি-চুপি ফিরে চলেছি। রাইসুদিন চাচার কবরের পাশ দিয়ে আসবার সময় দেখি, সেখানে কে দুটি ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রেখে গেছে। দুটি লিকলিকে ধোয়ার শিখা উড়ছে সেখান থেকে। ভয় পেয়ে নবুমামা আমার হাত চেপে ধরলেন।
শৈশবের এই অতি সামান্য ঘটনাটি আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে। পরিণত বয়সে এ নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। ছোট একটি ছেলে মৃত্যুর কথা মনে করে একা কষ্ট পাচ্ছে। এ ভাবতেও আমার খারাপ লাগত।
সত্যি তো, সামান্য কোনো ব্যাপার নিয়ে ভাববার মত মানসিক প্রস্তুতিও যার নেই, সে কেন কবরে ধূপের শিখা দেখে আবেগে টলমল করবে? কেন সে একা একা চলে যাবে সোনাখালি? সোনাখালির খালের বাধানো পুলের উপর বসে থাকতে থাকতে এক সময় তার কাঁদতে ইচ্ছে হবে?
আসলে আমি মানুষ হয়েছি। অদ্ভুত পরিবেশে। প্রকাণ্ড একটি বাড়ির অগুণতি রহস্যময় কোঠা। বাড়ির পেছনে জড়াজড়ি করা বাঁশবন। দিন-মানেই শেয়াল ডাকছে চারিদিকে। সন্ধ্যা হব-হব সময়ে বাশবনের এখানে-ওখানে জ্বলে উঠছে ভূতের আগুন। দোতলার বারান্দায় পা ছড়িয়ে বিচিত্র সুরে কোরান পড়তে শুরু করছে কানাবিবি। সমস্তই অবিমিশ্র ভয়ের।
আবছা অন্ধকারে কানাবিবির দুলে দুলে কোরান পাঠ শুনলেই বুকের ভেতর ধঙ্ক করে উঠত। নানিজান বলতেন, কানার কাছে এখন কেউ যেয়ো না গো। শুধু কানাবিবির কাছেই নয়, মোহরের মা পা ধোয়াতে এসে বলত, পুলাপান কুয়াতলায় কেউ যেও না। কুয়াতলায় সন্ধ্যাবেলায় কেউ যেতাম না। সেখানে খুব-একটা ভয়ের ব্যাপার ছিল। ওখানে সন্ধ্যাবেলায় যেতে নেই।
চারিদিকেই ভয়ের আবহাওয়া। নানিজানের মেজাজ ভাল থাকলে গল্প ফাঁদতেন। সেও ভূতের গল্প : হাট থেকে শোল মাছ কিনে ফিরছেন তার চাচা। চারদিকে অন্ধকার হয়ে এসেছে। শ্রাবণ মাস, বৃষ্টি পড়ছে। টিপ টপ। ডিসট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক ছেড়ে বাড়ির পথ ধরেছেন, ওমনি পেছন থেকে নাকিসুরে কে চেঁচিয়ে উঠলো, মাঁছটা আঁমারে দিঁয়ে যাঁ।
রাতের বেলা ঘুমিয়ে পড়া ছেলেমেয়েদের জাগিয়ে এনে ভাত খাওয়াত মোহরের মা। লম্বা পাটিতে সারি সারি থালা পড়ত। ঘুম-ঘুম চোখে ভাত মাখাচ্ছি, এমন সময় হয়ত ঝুপ করে শব্দ হল বাড়ির পেছনে। মোহরের মা খসখসে গলায় চেঁচিয়ে উঠল,
পেততুনি নাকি? পেততুনি নাকি রে?
নবুমামা প্রায় আমার গায়ের উপর হুমাড়ি খেয়ে চাপা সুরে বলত, ভয় পাচ্ছি, ও মোহরের মা, আমার ভয় লাগছে।
নানাজানের সেই প্রাচীন বাড়িতে যা ছিল সমস্তই রক্ত জমাট-করা ভয়ের। কানাবিবি তার একটি মাত্র তীক্ষা চোখে কেমন করেই-না তাকাত আমাদের দিকে। নবুমামা ধলত, ঐ বুড়ি আমার দিকে তাকালে কঞ্চি দিয়ে চোখ গেলে দেব। কানাবিবি কিছু না বলে ফ্যালফ্যালিয়ে হাসত। মাঝেমধ্যে বলত, পুলাপান ডরাও কেন? আমি কিতা? পেত্নী? পেত্নী না হয়েও সে আমাদের কাছে অনেক বেশি ভয়াবহ ছিল; শুধু আমরা নাই, বড়রা ও তাকে সমীহ করে চলতেন! আব্বা সমীহ করবে নাই-বা কেন? বড় নানিজানেবা নিজের মুখ থেকে শোনা গল্প।
তার বাপের দেশের মেয়ে কানাবিবি। বিয়ের সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। ফাই-ফরমাস খাটে। হেসে-খেলে বেড়ায়। একদিন দুপুরে সে পেটের ব্যথায় মরো-মরো। কিছুতেই কিছু হয় না, এখন-যায় তখন-যায় অবস্থা। নানাজান লোক পাঠিয়েছেন। আশু কবিবাজকে আনতে। আশু কবিরাজ এসে দেখে সব শেষ। বরফের মত ঠাণ্ডা শরীর; খাটিয়ায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁশ কাটতে লোক গেল। নানিজান মরার মাথার কাছে বসে কোরান পড়তে লাগলেন। অদ্ভূত ব্যাপারটা ঘটল ঠিক তখনই–আমার নানিজান ভয়ে ফিট হয়ে গেলেন। নানাজান আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠলেন, ইয়া মাবুদ, ইয়া মাবুদ! কারণ কানাবিবি সে সময়ে ভাল মানুষের মত উঠে বসে পানি খেতে চাচ্ছে। এর পর থেকে স্বভাব-চরিত্রেব আমল পবিবর্তন হল তার। দিনরাত নামাজ-রোজা। আমরা যখন কিছু কিছু জিনিস বুঝতে শিখেছি, তখন থেকে দেখছি, সে পাড়ার মেয়েদের তাবিজকবজ দিচ্ছে; সন্ধ্যা হতে-না-হতেই দোতলার বারান্দায় কুপি জ্বালিয়ে বিচিত্র সুরে কোরান পড়ছে। ভয় তাকে পাবে না কেন?
এ তো গেল রাতের ব্যাপার। দিনের বোলা ও কি নিস্তার আছে? গোল্লা ছুটি খেলতে গিয়ে যদি ভুলে কখনো পূর্বের ঘরের কাছাকাছি চলে গিয়েছি, ওমনি রহমত মিয়া বাঘের মতন গর্জন কলে উঠেছে, খাইয়া ফেলুম। ঐ পোলা, কাঁচা খাইয়া ফেলামু; কচ কচ কচ। ভয়ানক জোয়ান একটা পুরুষ শিকল দিয়ে বাঁধা, ব্যাপারটা ভয়াবহ। বদ্ধ পাগল ছিল রহমত মিয়া, নানাজানের নৌকার মাঝি। তিনি রহমতকে স্নেহ করতেন খুব, সারিয়ে তুলতে চেষ্টা ও করেছিলেন। লাভ হয়নি।
এ সমস্ত মিলিয়ে তৈরি হয়েছে আমার শৈশব। গাঢ় রহস্যের মত ঘিরে রয়েছে আমার চারদিক। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, অল্প বয়সের ভয়-কাতর একটি ছেলে তার নিত্যসঙ্গী নবুমামার হাত ধরে ঘুমুতে যাচ্ছে, দোতলার ঘরে। নবুমামা বলছেন, তুই ভিতরের জানালা দুটি বন্ধ করে আয়, আমি দাঁড়াচ্ছি বাইরে। আমি বলছি, আমার ভয় করছে, আপনি ও আসেন। মামা মুখ ভেংচে বলছেন, এতেই ভয় ধরে গেল! টেবিলে রাখা হ্যাঁরিকেন থেকে আবছা অ্যালো আসছে। আমি আর নবুমামা কুকুর-কুণ্ডুলি হয়ে লেপ মুড়ি দিয়ে গুয়ে আছি। নবুমামা শুতে-না-শুতেই ঘুম; একা একা ভয়ে আমার কান্না আসছে। এমন সময় বাড়ির ভেতব থেকে হৈচৈ শোনা গেল। শুনলাম, খড়ম পায়ে খটখট করে কে যেন এদিকে আসছে; মোহরের মা মিহি সুরে কাঁদছে, আমি অনেকক্ষণ সেই কান্না শুনে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। জানাতেও পারিনি সে-রাতে আমার মা মারা গিয়েছিলেন।
সে-রাতে আমার ঘুম ভেঙেছিল ফজরের নামাজের সময়। জেগে দেখি, বাদশা মামা চুপচাপ বসে আছেন চেয়ারে। আমাকে বললেন, আর ঘুমিয়ে কি কারবি, আয় বেড়াতে যাই। আমরা সোনাখালির খাল পর্যন্ত চলে গেলাম; সেখানে পাকা পুলের উপর দুজনে বসে বসে সূর্যোদয় দেখলাম। প্রচণ্ড শীত পড়েছিল সেবার। কুয়াশার চাদরে গাছপালা ঢাকা। সূর্যের আলো পড়ে শিশির-ভেজা পাতা চকচক করছে। কেমন অচেনা লাগছে সব কিছু। মামা অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, রঞ্জু, আজ তোর খুব দুঃখেব দিন। দুঃখের দিনে কি করতে হয় জানিস?
না।
হা হা করে হাসতে হয়। হাসলেই আল্যা বলেন, একে দুঃখ দিয়ে কোনো লাভ নেই। একে সুখ দিতে হবে। বুঝেছিস?
বুঝেছি।
বেশ, তাহলে হাসি দে আমার সঙ্গে।
এই বলে তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। বাদশা মামার খুব মোটা গলা ছিল। তার হাসিতে চারদিক গম গম করতে লাগল। আমি ও তাঁর সঙ্গে গলা মিলালাম। বাদশা মামা বললেন, আজ আর বাসায় ফিরে কাজ নেই, চল শ্রীপুর যাই। সেখানে আজ যাত্রা হবে। আমি মহাখুশি হয়ে তাঁর সঙ্গে চললাম।
কতদিনকার কথা, কিন্তু সব যেন চোখের সামনে ভাসছে।
বাদশা মামার সঙ্গে আমার কখনো অন্তরঙ্গতা হয়নি। অথচ আমরা একই ঘরে থাকতাম। দোতলার সবচেয়ে দক্ষিণেব ঘরে দুটো খাটের একটিতে বাদশা মামা, অন্যটিতে আমি আর নবুমামা। সারাদিন বাদশা মামার দেখা নেই। রাতে কখন যে ফিরতেন, তা কোনোদিনই জানিনি। ঘুম ভাঙার আগে-আগেই চলে গেছেন। কোনো কোনো বাতে ঘুম ভেঙে গেলে দেখেছি গুনগুন করে কী পড়ছেন। যেদিন মেজাজ ভালো থাকত সেদিন খুশি-খুশি গলায় বলতেন, রঞ্জু, শুন তো দেখি, কেমন হচ্ছে বলবি। আমি হঠাৎ ঘুম-ভাঙা অবস্থায় কী হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। মামা দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বলা শুরু করেছেন–
এ রাজ্যপাঠ যায় যাক,
কোনো ক্ষতি নেই
কিন্তু ত্ৰিদীব তুমি
কোথা যাবে?
ভরাট গলা ছিল তার, সমস্ত ঘর কোপে কেঁপে উঠত। মাঝপথে থেমে গিয়ে বলতেন, দাঁড়া, পোশাকটা পরে নেই, পোশাক ছাড়া ভাল হয় না। তোল, নবুকে ঘুম থেকে তোল। নবুমামার ঘুম ভাঙালেই প্রথম কিছুক্ষণ নাকি সুরে কাঁদত। বাদশা মামা বিরক্ত হয়ে বলতেন,–গাধা! দেখ না কী করছি। তারপর দুজনেই হাঁ করে তাকিয়ে থাকি বাদশা মামার দিকে। আলমারি খুলে তিনি মুকুট বের করেছেন, জড়িদার পোশাক পরেছেন। তারপর একা একাই অভিনয় করে চলেছেন। আমরা দুই শিশু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি।
বাদশা মামা প্রথম থেকেই আমাদের কাছে দূরের মানুষ। যিনি জরির পোশাক পরে রাতদুপুরে আমাদের অভিনয় দেখান, তিনি কাছের মানুষ হতে পারেন না। বাড়ির মানুষের কাছেও তিনি দল-ছাড়া। খুব ছোটবেলায় নানাজান তাকে একবার বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন। যে ছেলে স্কুল পালিয়ে যাত্ৰাদলে চলে যায়, নানাজানের মতো লোক তাকে ঘরে রাখতে পারেন না। খবর শুনে ছোট নানিজান খাওয়া-দাওয়া ছাড়লেন। মরো-মারো অবস্থা! নানাজান লোক পাঠিয়ে বাদশা মামাকে ফিরিয়ে আনলেন। সেই থেকে তিনি বাদশা মামাকে ঘাটান না! বাদশা মামাও আছেন আপন মনে।
বাদশা মামা আমার শিশুচিত্তকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিলেন। শিল্পীর সব সময়ই শিশুদের আকর্ষণ করে। হয়ত শিশুরাই প্রতিভার খবর পায় সবার আগে, কিন্তু বাদশা মামা দারুণ অসুখী ছিলেন। যে সামাজিক পদমর্যাদা তার ছিল তা নিয়ে যাত্ৰাদলের মানুষদের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতেন না। অথচ তাঁর চিন্তা-ভাবনার সমস্ত জগৎ যাত্ৰাদলকে ঘিরে। মাঝে-মাঝেই তাঁকে দেখেছি, বারান্দায় চেয়ার পেতে চুপচাপ বসে আছেন। যদি গিয়ে বলেছি,
মামা কি করেন?
কিছু না।
সকাল থেকে সন্ধ্যা হয়েছে, মামা তেমনি বসেই আছেন। কেউ যদি গিয়ে বলেছে,
বাদশা, তোর কি হয়েছে রে?
কিছু না।
মাঝে-মাঝেই এ রকম হত তাঁর। নানাজান তখন ক্ষেপে যেতেন। ছোট নানিজনকে ডেকে বলতেন, ভং ধরেছে নাকি? শক্ত মুগুড় দিয়ে পিটালে ঠিক হয়, বুঝেছ? নানিজান মিনমিন করে কী কৈফিয়ত দিতে চেষ্টা করেন। তারপর একসময় দেখা যায়, তিনি বাড়ির পেছনে দাঁড়িয়ে বিনিয়ে-বিনিয়ে কাঁদছেন।
নানাজানকে সবাই ভয় করতাম আমরা। দোতলা থেকে একতলায় তিনি নেমে এলে একতলা নীরব হয়ে যেত। খুব কম বয়সী শিশু, যাদের এখনো বিচার-বুদ্ধিও হয়নি, তারাও নানাজানকে দেখলে ফ্যাকাসে হয়ে যেত। ভয়টাও বহুলাংশে সংক্ৰামক।
ভোরবেলায় ঘুম ভাঙত নানাজানের কোরান পাঠের শব্দে। মোটা গলা, টেনে টেনে একটু অনুনাসিক সুরে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। তখন মাথায় থাকত লাল রংয়ের ঝুটি ওয়ালা একটা ফেজ টুপি। খালি গা, পরনে সিন্ধের ধবধবে সাদা লুঙ্গি। হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ঝুকে ঝুকে অনেকক্ষণ ধরে পড়তেন। পড়া শেষ হয়ে গেলে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকতেন। ছোট নানিজান এই সময়ে জাম-বাটিতে বড় এক বাটি চা তৈরি করে নিয়ে যেতেন। নানাজান চুকচুক করে অনেকটা সময় নিয়ে চা খেতেন। তারপর নিজের হাতে হাঁসের খোয়াড় খুলে দিতেন। পাশেই মুরগির খোয়াড়, সেটিতে হাতও দিতেন না। হাঁসগুলি ছাড়া পেয়ে দৌড়ে যেত পুকুরের দিকে। তিনিও যেতেন পিছু পিছু। সমস্তই রুটিন বাধা, একচুলও এদিক-ওদিক হবার জো নেই।
কিছু কিছু মানুষ ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে, আবার কারো কারো কাছে ভাগ্য আপনি এসে ধরা দেয়। নানাজান এ দুটির কোনোটির মধ্যেই পড়েন না। পূৰ্বপুরুষের গড়ে যাওয়া সম্পদ ও সম্মানে লালিত হযেছেন। কিন্তু অসংযমী হননি। অহংকার ছিল খুব, সে অহংকার প্রকাশ পেত বিনয়ে। হয়ত কোনো আত্মীয়-কুটুম্ব এসেছে বেড়াতে; নানাজান ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন। বার বার বলছেন, গরিবের ঘরে এসেছেন, কী দিয়ে খেদমত করি, বড়ো সরমিন্দায় পড়লাম, বড়ো কষ্ট হল আপনার; ওরে তামুক আন, আর খাসি ধর দেখি একটা ভাল দেখে। যিনি এসেছেন, আয়োজনের বাহুল্য দেখে তিনি লজ্জায় পড়ে যেতেন।
পঁয়ত্ৰিশ বছর আগের দেখা চিত্র। স্মৃতি থেকে লিখছি। সে স্মৃতিকে বিশ্বাস করা চলে। আমরা যারা ছেলে-ছোকড়ার দলে, তাদের প্রতি নানাজানের কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল না। একা একা থাকতেন। সারাক্ষণই। বড়ো নানিজান তো কিছু পরিমাণে অপ্রকৃতস্থই ছিলেন। তিনি দোতলা থেকে নামতেন। কালে-ভদ্রে। ছোট নানিজানও যে কখনো হালকা সুরে নানাজানের সঙ্গে আলাপ করছেন, এমন দেখিনি। খালারাও আমাদের মত দূরে দূরে থাকতেন। ক্ষমতাবান লোকরা সব সময়ই এমন নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়ে যায়।
কেন জানি না, আমার নিজের খুব ইচ্ছে হত নানাজানের সঙ্গে ভাব করি। ঘুমোতে যাবার আগে কতদিন ভেবেছি, নানাজান যেন এসে আমাকে বলছেন, আয় রঞ্জু বেড়াতে যাই। আমি তার হাত ধরে চলেছি বেড়াতে। কতদিন ভেবেছি আজ ঘুম থেকে উঠেই নানাজানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব।
কিন্তু সে আর হয়ে ওঠেনি। ঘুম ভাঙতেই তাড়া পড়েছে, ওজু করে পড়তে যা, ওজু করে পড়তে যা। মৌলভী সাহেব বসে আছেন বাইরের ঘরে। আমরা সবাই আমপারা হাতে করে একে একে হাজির হচ্ছি। মেয়েরা ডান পাশে, ছেলেরা বাঁপাশে। সমবেত কণ্ঠে অ্যাওয়াজ উঠছে, আলিফ দুই পেশ উন, বে দুই পেশ বুন। নাশতা তৈরি হওয়া মাত্র আরবি পড়া শেষ। তারপর ইংরেজি, বাংলা আর অংকের পড়া। পড়াতে আসতেন রাম মাস্টার। ভারি ভাল মাস্টার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতেন। নবুমামা ছাড়া বনিয়েছিলেন–
রাম মাস্টার বুড়া
এক পা তার খোঁড়া
স্কুলে যাবার আগ পর্যন্ত পড়াতেন তিনি। তার কাছে পড়ত শুধু ছেলেরাই। মেয়েদের আরবি ছাড়া অন্য কিছু পড়বার প্রয়োজন ছিল না। তারা ঘরের কাজ করত, জরি দিয়ে লতা-পাতা ফুল বানাত, বালিশের ওয়াড়ে নকশা তুলে লিখত, ভুল না আমায়। রাম মাস্টার চলে যেতে যেতে স্কুলের বেলা হয়ে যেত। স্কুল শেষ হয়ে গেলে তো খেলারই পাঠ। সূর্য ডুবে অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত চলত হৈ হৈ। ফুরসত ফেলার সময় নেই। এর মধ্যেই লিলি এসে আমাকে নিয়ে যেত বাড়ির ভেতর। সে নিজেকে সব সময় ভাবত আমার একজন অভিভাবক। সে যে আমার বড়বোন এবং নানাজানের এই প্রকাণ্ড বাড়িতে আমিই যে তার সবচেয়ে নিকটতম জন, তা জানাতে তার ভারি আগ্রহ ছিল।
শাড়ি-পরা তার হালকা-পাতলা শরীর কোনো ফাঁকে আমার নজরে পড়ে গেলেই মন খারাপ হয়ে যেত। অবধাবিতভাবে সে হাত ইশারা করে আমায় ডাকবে। ফিসফিস করে বলবে, কাল সবাই দুখান করে মাছ ভাজা খেয়েছে, আর তুই যে মোটে একটা নিলি।
একটাই তো দিয়েছে আমাকে।
বোকা কোথাকার। তুই চাইতে পারলি না? আর দুধ দেবার সময় বলতে পারিস না, আরেক হাতা দুধ দাও মোহরের মা?
দুধ ভাল লাগে না আমার।
ভাল না লাগলে হবে? স্বাস্থ্য ভাল করতে হবে না? বেকুব কোথাকাব।
এই বলে সে হয়ত কাঁচা-মিঠা গাছের আমি এনে দিল আমার জন্য। আবার কোনোদিন হয়ত ডেকে নিয়ে গেল বাড়ির পেছনে। আগের মতো গলা নেমে গেছে খাদে। ফিসফিস করে বলছে, কি ভাবিস তুই, আমরা কী ফ্যালনা? বড় নানীজানের সম্পত্তির অংশ পাব না। আমরা? নিশ্চয়ই পাব। বড় নানিজানের মেলা সম্পত্তি। আর আমাদের মা হচ্ছে তার একমাত্র মেয়ে। আমরা দুজনেই শুধু ওয়ারিশান। বুঝলি?
হ্যাঁ, বুঝেছি।
কাঁচকলাটা বুঝেছিস। হাদার বেহদ্দ তুই। ছিঃ ছিঃ, এতটুকু বুদ্ধিও নেই। নে, এটা রাখা তোর কাছে।
তাকিয়ে দেখলাম চকচকে সিকি একটা।
কই পেয়েছে?
আমার ছিল বলেই লিলি আবাব ফিসফিস করে বলল,
দেখিস আবার, গাধার মত সবাইকে বলে বেড়াবি না।
না, বলব না।
লিলিব ভাবভঙ্গি থেকে বোঝা যায়, পয়সাটা অন্যভাবে জোগাড় করেছে সে। আমরা দুভাইবোন কখনো হাতে পয়সা পেয়েছি, এমন মনে পড়ে না। অল্প বয়সে স্নেহটাকে বন্ধন মনে হত না। চাইতেই যা পাওয়া যায় তা তো সব সময়ই মূল্যহীন।
লিলিকে ভাল লাগত কালে-ভদ্রে। যেদিন সে খেয়ালের বসে সামান্য সাজ করে লজ্জা-মেশানো গলায় আমাকে দোতলায় ডেকে নিয়ে যেত, সেদিন তাকে আমি সত্যি সত্যি ভালবাসতাম। কিংবা কে জানে অল্প বয়সেই হয়ত করুণা করতে শিখে গিয়েছিলাম। সে কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নাক-মুখ অল্প লাল করে বলত,
আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোকে সঙ্গে করে নিযে যাব, তুই থাকবি আমার সঙ্গে?
কবে বিয়ে?
হবে শিগগির।
তারপরই যেন নেহায়েত একটা কথার কথা এমনিভাবে বলে বসত, দেখ তো রঞ্জু, শাড়িতে আমাকে কেমন মানায়?
ভাল।
কিন্তু আমার নাকটা যে একটু থ্যাবড়া।
এ বাড়ির কাউকেই লিলি দেখতে পারত না। ভেবে পাই না কেমন কবে এত হিংসা পুষে সে বড় হয়েছে। আমি ছাড়া আর একটিমাত্র মানুষের সঙ্গে তার অল্পবিস্তর খাতির ছিল। তিনি আমাদের বড় নানীজান। বড় নানীজান থাকতেন দোতলায় বাঁদিকের সবচেয়ে শেষের ঘরটায়। অন্ধকার ছোট একটি কুঠুরি। জানালার সামান্য যে ফাঁক দিয়ে আলো-বাতাস আসে, তাও গাবগাছের ঝাঁকড়া ডালপালা অন্ধকার করে রেখেছে। আলো-বাতাসহীন সেই অল্প পরিসর ঘরে বড় নানীজান রাতদিন বসে আছেন। দেখে মনে হবে, নানাজানের দেড়গুণ বেশি বয়স। সমস্ত মাথায় চুল পেকে ধবধব করছে। দাঁত পড়ে গাল বসে গেছে। নিচের মাড়িতে একটি মাত্র নোংরা হলুদ দাঁত। মাঝে-মধ্যে তিনি রেলিং ধরে কাঁপা কাঁপা পায়ে নিচে নেমে আসতেন। কি ফুর্তি তখন আমাদের! সবাই ভিড় করেছি তার চারপাশে। নানীজান মস্ত একটি মাটির গামলায় দুপয়সা দামের হলুদ রঙের হেনরী সাবান গুলে ফেনা তৈরি করেছেন। ফেনা তৈরি হলেই ঢালাও হুকুম—মুরগি ধইরা আন। মুরগি ধরে আনবার জন্য ছোটাছুটি পড়ে যেত আমাদের মধ্যে। সব মুরগি নয়, শুধু ধবধবে সাদা মুরগি ধরে আনবার পালা। নানীজান সেগুলিকে সাবান-গোলা পানিতে চুবিয়ে পরিষ্কার করতেন। পাশেই বালতিতে নীল রঙ গোলা থাকত। ধোয়া হয়ে গেলেই নীল রঙ-এ চুবিয়ে ছেড়ে দেয়া। কি তুমুল উত্তেজনা আমাদের মধ্যে।
টগরের সঙ্গে যখন গল্প করলাম। সে নিচের ঠোট উল্টে দিয়ে বলল, এত মিথ্যে কথাও তোমার আসে? ছিঃ ছিঃ!
মিথ্যে নয় বলে তাকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারলাম না। বড় নানীজনকে নিয়ে কত বিচিত্র সব গল্প আছে। তাঁর ভূতে পাওয়ার গল্পটিও আমি টগরকে শুনিয়েছিলাম।
বড় নানীজনের অভ্যোস ছিল, সন্ধ্যাবেল পুকুরে সাঁতার কেটে নাওয়া। তখন কার্তিক মাস। অল্প-অল্প হিম পড়েছে। নানীজান গিয়েছেন অভ্যেসমত গোসল সারাতে। সূর্য ডুবে অন্ধকার হল, তার ফিরবার নাম নেই। মোহরের মা হ্যাঁরিকেন জ্বালিয়ে পুকুরঘাটে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখে, কোমর-জলে দাঁড়িয়ে তিনি থর থর করে কাপছেন। মোহরের মা ভয় পেয়ে বলল, কি হয়েছে গো?
নানীজান অস্পষ্টভাবে টেনে টেনে বললেন, ও মোহরের মা, টেনে তোল আমাকে, আমি উঠতে পারি না, কত চেষ্টা করলাম উঠতে।
টগর বলল, হিস্টিরিয়া ছিল তোমার নানীর। ভূত-ফুত কিছু নয়। তোমার বড় নানীজানের। ছেলেমেয়ে হয়নি নিশ্চয়ই।
না, হিস্টিরিয়া ছিল না তার। আর ছেলেমেয়ে ছিল না, তাও নয়। বড় নানীজনের একটি মাত্র মেয়ে ছিল, হাসিনা। সবাই ডাকত হাসনা। তিনি আমার আর লিলির মা।
হাসনা তিন মাসের একটি শিশুকে কোলে করে আর চার বছরের একটি মেয়ের হাত ধরে এ বাড়িতে এসে উঠেছিল। কোনো একটি বিশেষ ঘটনার কাল্পনিক চিত্র যদি অসংখ্যাবার আঁকা যায়, তাহলে এমন একটি সময় আসে যখন সেই কাল্পনিক চিত্রকেই বাস্তব বলে ভ্রম হয়। আমি মাধ। এ বাড়িতে আসার ঘটনাটি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাই। প্রতিটি ডিটেল অত্যন্ত সূক্ষ্ম।
তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। হ্যাঁরিকেন আর কুপি মিলিয়ে পনেরো-বিশটি বাতি জ্বলছে এখানেওখানে। বিল থেকে ধরে আনা মাছের গাদার চারপাশে বলে বউ-ঝিরা মাছ কুটিছেন আর হাসিতামাশা করছেন। হাসনা এল ঠিক এ সময়ে। অত্যন্ত জেদী ভঙ্গিতে সে উঠোনে এসে দাঁড়াল। তাকে দেখতে পেয়ে সবাই অবাক হয়ে নেমে এল উঠোনে। খড়ম খট খট করে নানাজান নেমে এলেন দোতলা থেকে আর হাসনা শুকনো চোখে দেখতে লাগল সবাইকে।
হাসনার বিয়েতে সারা গাঁর দাওয়াত ছিল। হিন্দুরা মুসলমান বাড়িতে এখন ইচ্ছে করে মাংস খেতে আসেন, তখন আসতেন না। হিন্দুদের জন্যে ঢালাও মিষ্টির ব্যবস্থা। নাম-করা কারিগর রমেশ ঠাকুর দু’দিন আগে বাড়িতে ভিয়েন বসালেন।
আত্মীয়-কুটুম্বের জায়গা হয় না ঘরে, নতুন ঘর উঠল এদিকে-ওদিকে। গাঁয়ের দারোগা খেতে এসে আঁৎকে উঠে বলল, করছেন কি খান সাহেব? এ যে রাজরাজাদের ব্যাপার! নানাজান হাসিমুখে বললেন, প্রথম মেয়ের বিয়ে, সবাইকে না বললে খারাপ দেখায়, সবাই আত্মীয়-স্বজন।
গ্রামের নিতান্ত গরিব চাষীও মেয়ের বিয়েতে দুবিঘা জমি বিক্রি করে ফেলে, হালের গুরু বেঁচে দেয়। আর নানাজান তখন টাকার উপর শুয়ে।
হাতি আনতে লোক গেল হালুয়াঘাট। সেখানে কালুশেখের দুটি মাদী হাতি আছে। বন থেকে–কাঠের বোঝা টেনে নামায়। বিয়ের আগের রাতে মাহুতকে ঘাড়ে করে মাতৃ এসে দাঁড়াল। উৎসাহী ছেলেমেয়েরা কলাগাছের পাহাড় বানিয়ে ফেলল উঠোনে। মাহুতের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলার জন্য কী আগ্রহ সবার। মাহুত সাহেব কী একটু তামাক খেতে ইচ্ছে করবেন?
হাতির পিঠে চড়ে বর এসে নামল। লোকে লোকারণ্য। ভিড়ের চাপে গেট ভেঙে পড়ে, এমন অবস্থা। জরীর মালায় বরের মুখ ঢাকা। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। কলম পড়ানোর আগে জরীর মালা সরানো হবে না। সে-ও রাত একটার আগে নয়। বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে বর বন্ধুদের নিয়ে সিগারেট খেতে গেল বাইরে। আমনি হৈ-হৈ করে উঠল। সবাই, দেখেছি! কী রঙ! যেন সাহেবদের রঙ। রাজপুত্র এসে দাঁড়িয়েছে যেন!
লিলিরও বিয়ে হল এই বাড়িতে। দশ-পনের জন বন্ধু নিয়ে রোগামত একটি ছেলে বসে রইল বাইরের ঘরে। নিতান্ত দায়সারা গোছের বিয়ে। ভাল ছেলে পাওয়া গেছে, এই তো ঢের। তাছাড়া গয়না-টয়নাও তো নেহায়েত কম দেওয়া হয়নি। মায়ের গলার হার, হাতের ছ’গাছা চুরি, নানীজান দিলেন কানের দুল, ছোট নানীজান নাম-লেখা আংটি। কবুল বলতে গিয়ে লিলি তবু কেঁদে-কেটে অস্থির। নানাজানের প্রবল ধমকের এক ফাঁকে কখন যে কবুল বলেছে তা শুনতেই পেল না কেউ।
ন’মাইল পালকি করে গিয়ে ট্রেন। ট্রেন পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে আসব আমি আর নবুমামা। বেডিংপত্তর নিয়ে দুজন কমলা আগে আগে চলে গিয়েছে। পালকির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না, বারবার পিছিয়ে পড়ি। নবুমামা বললেন, পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে, আমি জুতা খুলে ফেললাম।
সজনিতলা এসে পান্ধি থামল। বেহারারা জিরোবে। পান-তামুক খাবে। লিলি পালকির ফাঁক থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকল, এই রঞ্জু, দুষ্টামি করবি না তো?
না।
আমার জন্য কাঁদবি না তো?
না, কাঁদব না।
কাঁদবি না কী রে গাধা? বোনের জন্য না কাঁদলে কার জন্য কাঁদবি? আমার কী আর কেউ আছে?
ট্রেন ছেড়ে দিল।
এই বাড়ি ঐ বাড়ি করে ট্রেন দ্রুত সরে যাচ্ছে। নবুমামা কাঁদছেন হু হু করে। বেহার এসে বলল, দুজনে এসে বসেন পালকিতে, ফিরিয়ে নিয়ে যাই।
লিলিকে ট্রেনে উঠিয়ে দিয়ে এসে আমার বয়স যেন হঠাৎ করে বেড়ে গেল। মনে হল কিছু কিছু চিরন্তন রহস্য যেন বুঝতে পারছি।
চলবে,,,,,,,,,,,,
No comments