Ads

সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটো গল্প --"উন্মোচনের মুহূর্তে" @মিঃ মধু

---উন্মোচনের মুহূর্তে---  
সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়
  
সূনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোটো গল্প --"উন্মোচনের মুহূর্তে"  @মিঃ বুদ্ধিমান গাধা

"উন্মোচনের মুহূর্তে"

কাল ইন্দ্রজিৎ নতুন কলেজে ভরতি হবে, থাকতে হবে কলকাতার বাইরে। 
আজ থেকেই তার শরীরে একটা অদ্ভুত উত্তেজনা। 
সে সর্বক্ষণ ছটফট করছে, খালি মনে হচ্ছে, কিছু যেন ভুল হয়ে গেছে।

তার বাক্স গুছোনো হয়ে গেছে এরই মধ্যে। দু-জোড়া নতুন শার্ট-প্যান্ট তৈরি করতে দেওয়া হয়েছিল, 
দর্জির কাছ থেকে ঠিক সময়ে পাওয়া গেছে। পোস্ট অফিস থেকে নিজের জমানো সামান্য কিছু টাকাও তুলে এনেছে সে। দরকারি কাগজপত্র সব রেডি। তবু ইন্দ্রজিতের মনে হচ্ছে, শেষ মুহূর্তে বোধহয় একটা টেলিগ্রাম আসবে, তোমাকে যেতে হবে না।

ইন্দ্রজিতের ছটফটানি দেখে তার দাদা বলল, ইস, তুই এমন করছিস যেন মনে হচ্ছে বিলেত যাচ্ছিস! 
এই তো এইখান থেকে…ট্রেনে মাত্র তিন ঘণ্টার রাস্তা…
ইন্দ্রজিৎ বলল, সে জন্য না কি! হোস্টেলে থাকার জায়গা আছে কি না সে সম্পর্কে এখনও কোনও চিঠি দেয়নি…
দূর বোকা ছেলে! এর আবার আলাদা চিঠি দেওয়ার কী আছে? রেসিডেন্সিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ…
এখানে সবাই তো হস্টেলে থাকে।
ইন্দ্রজিতের দাদা আর্টসের ছাত্র, কিন্তু ভাব দেখাচ্ছে এমন, যেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সম্পর্কে ও সব কিছু জানে।

বিকেলে ইন্দ্রজিতের বন্ধুরা কয়েকজন দেখা করতে এসেছে। এদের মধ্যে দুজন ভরতি হওয়ার সুযোগ পেয়েছে শিবপুরে আর যাদবপুরে, তিনজন ডাক্তারিতে ঢুকেছে, আর কোথাও সুযোগ পায়নি এবার। 
তারা বাধ্য হয়ে এমএসসি পড়বে। তাই মুখ বিরস। অলক ভরতি হয়েছে শিবপুরে, সে ইন্দ্রজিৎকে, বলল, 
তুই শিবপুরে চান্স নিলি না কেন? শুধু-শুধু অতদূরে যাচ্ছিস!

ইন্দ্রজিৎ বলল, আমি দূরেই যেতে চেয়েছি ইচ্ছে করে।

কেন রে?

ইন্দ্রজিৎ দেখল, তার বোন রূপা বসবার ঘরের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল রাস্তায়। সেই জন্য ইন্দ্রজিৎ একটু ঢোক গিলে সময় নিল। তারপর গলা নামিয়ে বলল, আমার বহুকালের শখ স্বাধীনভাবে হোস্টেলে থাকা।

যাচ্ছেতাই খাবার দেয়।

দিক গে! তবু তো সবসময় সেখানে বাবা দাদার শাসন নেই। নিজে ঘরে ইচ্ছে মতন থাকব, 
যখন যা খুশি বই পড়ব…

তোদের হোস্টেলে তো গেস্ট হাউস আছে। আমরা মাঝে-মাঝে বেড়াতে যাব, বুঝলি?

ঠিক আসবি তো?

বন্ধুদের সবার ইচ্ছে সেদিন সন্ধেবেলা একটা সিনেমা দেখার। ইন্দ্রজিৎকেই দেখাতে হবে।

ইন্দ্রজিৎ বলল, আজ বেরুনো অসম্ভব রে! আমার বড়মামার বাড়িতে নেমন্তন্ন। একবার যেতেই হবে।

একটু বেশি রাত করে যাবি!

ইমপসিবল! মাকে নিয়ে যেতে হবে, অনেক ঝামেলা আছে। আমি তো আড়াই মাস বাদেই পুজোর ছুটিতে আবার আসছি। তখন সিনেমা দেখাব, কথা দিলাম…

আড়াই মাস বাদে? এর মাঝখানে আসবি না? উইক-এন্ডেই চলে আসতে পারিস!

দেখি!

বন্ধুদের রাস্তার মোড় পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ইন্দ্রজিৎ আবার ফিরে এলো বাড়িতে। বারবার হাতের ঘড়ি দেখছে।

ইন্দ্রজিতের ঘড়ি ছিল না। তার দাদা উদারতা দেখিয়ে নিজের ঘড়িটা আজ সকালেই দিয়ে দিয়েছে ইন্দ্রজিৎকে। দাদার বিয়ের কথাবার্তা হচ্ছে। তখন তো একটা ঘড়ি পাবেই। হাতে নতুন ঘড়ি পরলে বারবার সময় দেখতে ইচ্ছে করে। বাড়ি ফিরে আসার পর মা বললেন, এখন আর। কোথাও বেরুসনি যেন। 
তোর বড়মামার বাড়িতে আজ নেমন্তন্ন, মনে আছে তো?

ইন্দ্রজিৎ বলল, আমার না গেলে হয় না?

মা বললেন, দূর পাগল! তোর জন্যেই তো বিশেষ করে…

কিন্তু আমাকে যে একজায়গায় যেতেই হবে একবার?

কোথায়?

দিব্যর ভীষণ অসুখ। ওর সঙ্গে একবার দেখা না করে গেলে খুব খারাপ দেখাবে। 
সেই ছোটবেলা থেকে ওর সঙ্গে পড়েছি।

ঠিক আছে, এখন তার সঙ্গে চট করে দেখা করে আয়। তারপর যাবি।

ওরা টালিগঞ্জে থাকে তো। যাতায়াতেই অনেকটা সময় লেগে যাবে। আমি ওখান থেকে সোজা বড়মামার বাড়িতে যাব। তুমি দাদার সঙ্গে চলে যেও।

ইন্দ্রজিৎ ওপরে নিজের ঘরে গেল জামাকাপড় বদলাতে। ঘরটা কীরকম খালি-খালি দেখাচ্ছে। তার নিজস্ব অনেক জিনিসপত্রই সে দিয়ে দিয়েছে তার ছোটভাই রুনু আর বোন রূপাকে। যেন সে চিরকালের মতন চলে যাচ্ছে এখান থেকে। সেই রকমই অনেকটা মনে হয়। ইন্দ্রজিৎ তো এর আগে কখন বাড়ির বাইরে থাকেনি।

সাদা প্যান্ট আর সাটা শার্ট পরল ইন্দ্রজিৎ। তার অনেক রঙিন জামা আছে, তবু এক-একদিন। সাদা পরতেই তার ভালো লাগে। জুতো জোড়া সকালেই পালিশ করেছে, তবু আর একবার বুরুশ বুলিয়ে নিল। তার জল তেষ্টা পেয়েছিল, চুল আঁচড়াতে-আঁচড়াতে সে অভ্যেসবশত চেঁচিয়ে বলতে যাচ্ছিল, মা, একগ্লাস জল দিয়ে যাও তো! কিন্তু, বলল না। হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল, হোস্টেলে গিয়ে তো নিজের সব কাজ নিজেকেই করতে হবে, আজ থেকেই অভ্যাস করা ভালো। নিজেই জল গড়িয়ে খাবে সে।

চুল আঁচড়াবার পরও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রইল ইন্দ্রজিৎ। সে নিজেকে দেখছে। এবং অন্য কার উদ্দেশে যেন বলল, আমাকে মনে থাকবে তো।

আয়নার কাছ থেকে সরে এসে সে সুটকেস খুলে বেশ কয়েকখানা দশটাকার নোট পকেটে ভরল। তারপর তরতর করে নেমে এলো সিঁড়ি দিয়ে।

মা বললেন, বেশি দেরি করিস না যেন!

ইন্দ্রজিৎ যখন বলল, আচ্ছা, ততক্ষণে সে সদর দরজা পেরিয়ে এসেছে। জল খাবার কথা আর

মনে পড়ল না তার।

খানিকটা দূর গিয়ে দেখল তার বোন রূপা বাড়ির দিকে ফিরে আসছে। ইন্দ্রজিৎ একটা নিশ্চিন্ত নিশ্বাস ফেলল।

রূপাকে জিগ্যেস করল, কোথায় গিয়েছিলি?

নমিতাদের বাড়িতে।

তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। বড়মামার বাড়িতে যেতে হবে না!

রূপা একটু অবাক হয়ে জিগ্যেস করল, তুমি এত আগে-আগে কোথায় যাচ্ছ?

ইন্দ্রজিৎ বলল, এই একটু ঘুরে আসছি। তোর এত কথায় দরকার কী?

রূপা মুচকি হাসল। তারপর ধীর পায়ে হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে।

বাসের জন্য পাঁচ মিনিটের বেশি অপেক্ষা করার ধৈর্য হল না ইন্দ্রজিতের। প্রথম বাসটায় ভিড় দেখেই সে মেজাজের মাথায় একট ট্যাক্সি নিয়ে ফেলল। ট্যাক্সি ময়দান ঘুরে রেড রোড দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ মাঝপথে ইন্দ্রজিৎ বলল, রোককে, রোককে।

ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সে ময়দানের পাশ দিয়ে খুব মন্থরভাবে হাঁটতে লাগল। ঘনঘন ঘড়ি দেখছে। 
সওয়া ছটা বাজে। মাথার উপর ঝুঁকে আছে সন্ধেবেলা, এখনও নীচে নামেনি। বিকেলের আলো সদ্য ম্লান হতে শুরু করেছে। দূরে চৌরঙ্গির বিজ্ঞাপনের আলোগুলোও সৃষ্টি করছে লাল-নীল আভা। রেড রোড দিয়ে মোটর গাড়ি ছুটে যাচ্ছে সটসট করে।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়াল ইন্দ্রজিৎ। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে একটা ধরাল কায়দা করে। তাকে দেখলেই বোঝা যায় সে সদ্য সিগারেট টানতে শিখেছে। তার একুশ বছরের তাজা মুখে এখন উত্তেজনার আভাস।

ভিক্টোরিয়ার সামনে প্রচুর নারী, পুরুষ ও শিশুর ভিড়। অনেক রকম খাবারওয়ালা। কয়েকজন আবার ট্রানজিস্টার বাজাচ্ছে। ইন্দ্রজিৎ একবার তাকাচ্ছে সেই ভিড়ের দিকে, আবার দেখল ঘড়ি।

এত ব্যগ্রভাবে সে প্রতীক্ষা করছিল, এ তো তীক্ষ্ণনজর রেখেছিল, তবু চন্দনা কখন তার পাশে এসে দাঁড়াল সে লক্ষই করেনি।

চন্দনা বলল, এই।

ইন্দ্রজিৎ চমকে উঠল একেবারে।

দুজনে পরস্পরের দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, ঠিক যেন চুম্বকে আকৃষ্ট। 
চুম্বকটা কার শরীরে রয়েছে, তা বোঝা যায় না।

তারপর চন্দনা বলল, তুমি কতক্ষণ এসেছ?

অনেকক্ষণ।

আমি তো দেরি করিনি।

তবু আমার মনে হচ্ছিল, কত ঘণ্টা ধরে যেন দাঁড়িয়ে আছি এখানে। ভাবছিলাম, তুমি বোধহয় আসবে না। একবার তো রূপাকে বাড়ি থেকে বেরুতে দেখে ভয় পেয়েছিলাম। রূপা যদি তোমাদের বাড়িতে যেত…তা হলে তুমি বেরুতে পারতে না।

চন্দনা একটু হেসে বলল, তাও তো অনেক কষ্ট করে বেরুতে হল। কত মিথ্যে কথা যে বলতে হয়। 
তোমার জন্য।

ইন্দ্রজিৎ বলল, আর বলতে হবে না। কাল থেকে তো আমি আর থাকবই না।

মাসে একবার আসবে তো?

তার কী কোনও ঠিক আছে? হোস্টেলের নিয়মকানুন কিছুই জানি না।

ওসব জানি না। তোমাকে আসতেই হবে।

কথা বলতে-বলতে দুজনে এগিয়ে গেল মাঠের মধ্যে। পুলিশ পোস্টের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেল আর-একটু দূরে। একটা কালভার্ট খালি ছিল, সেখানে চন্দনা বসতে যাচ্ছে, ইন্দ্রজিৎ বলল, একটু দাঁড়াও! 
পকেট থেকে রুমাল বার করে জায়গাটা ঝেড়ে দিয়ে তারপর রুমালটা পেতে দিয়ে চন্দনাকে বলল, বসো!

চন্দনা বলল, রুমালটা পাতার দরকার নেই। কেন ময়লা করছ শুধু-শুধু।

ইন্দ্রজিৎ বলল, কিছু হবে না। আমার ইচ্ছে করছে। তুমি বসো!

চন্দনা বলল, বেশিক্ষণ থাকতে পারব না কিন্তু!

তুমি তো এসেই খালি যাওয়ার কথা বলো! আজ আমি সহজে ছাড়ছি না।

না, লক্ষ্মীটি। এক ঘণ্টা থাকব, তার বেশিনয়। বাস থেকে নামছি, অমনি সুব্রতদার সঙ্গে দেখা। দুজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, এদিকে কোথায় যাচ্ছ! আমি তাড়াতাড়ি বানিয়ে বললাম, ব্রিটিশ কাউন্সিল থেকে বই নিতে এসেছি। সেইজন্যই তো ওইদিকে দিয়ে আমাকে ঘুরে আসতে হল।

চন্দনাদের বাড়ির একতলার ফ্ল্যাট থাকে সুব্রত। ইন্দ্রজিতের চেয়ে বছরচারেকের বড়, খুব ভালো ক্রিকেট খেলে, পঙ্কজ রায়ের প্রিয় শিষ্য।

ইন্দ্রজিৎ রেগে গিয়ে বলল, সুব্রতদা কি তোমার গার্জেন নাকি?

চন্দনা বলল, না-না, তা নয়। সুব্রতদা কিছু বলেন না। বেশি দেরি করে ফিরলে…ওদের ঘর থেকে দেখা যায় তো…ব্রিটিশ কাউন্সিল আটটায় বন্ধ হয়ে যায়।

সে জন্য সুব্রতদাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?

একটু থেমে ইন্দ্রজিৎ আবার বলল, সুব্রতদার বেশ মজা। একই বাড়িতে থাকে, তোমাকে সারাদিন দেখতে পারে, যখন খুশি গল্প করতে পারে, তুমি সুব্রতদার ফ্ল্যাটে দিনে কবার যাও?

চন্দনা আরক্ত হয়ে বলল, এই ওরকম করে বলো না। খুব ভালো লোক। কক্ষনো খারাপ কিছু বলেন না।

ওরকম ভালো লোক আমার দেখা আছে।

তুমি কাল চলে যাচ্ছ, আর আজ আমার সঙ্গে এইরকম বকে-বকে কথা বলবে?

এদিক ওদিক তাকিয়ে চন্দনা আস্তে-আস্তে তার হাতটা ইন্দ্রজিতের হাতের ওপর রাখল। 
তাতেই বুক জুড়িয়ে গেল ইন্দ্রজিতের। সামান্য একটু সরে এলো চন্দনার দিকে।

আমি কাল চলে যাব বলে তোমার মন খারাপ হচ্ছে?

ভীষণ।

পাঁচটা বছর তো মোটে। দেখতে-দেখতে কেটে যাবে।

তুমি মাসে একবার করে আসবে, কথা দাও।

তা বলতে পারছি না। তবে পুজোর সময় তো আসবই।

পুজোর সময় আবার আমি থাকব না। আমাদের বাড়িশুদ্ধ সকলের পুরী যাওয়ার কথা হচ্ছে। ভালো লাগে না।

সুব্রতদাও সঙ্গে না কি!

আবার এ কথা? আমি এক্ষুনি চলে যাব তা হলে।

সুব্রতর ব্যাপারে ইন্দ্রজিতের হৃদয় অত্যন্ত স্পর্শকাতর। বস্তুত, অন্য কোনও ছেলে যদি চন্দনার সঙ্গে একটা কথা বলে, তাও ইন্দ্রজিৎ সহ্য করতে পারে না। তার ধারণা, চন্দনা তার একার। নিজস্ব।

সে চন্দনার হাতে একটা চাপ দিল। তারপরেই জিজ্ঞাসা করল, আমাকে চিঠি লিখবে তো? প্রত্যেক সপ্তাহে?

আর তুমি?

তোমাদের বাড়িতে চিঠি লিখলে যাবে?

তুমি চিঠির তলায় একটা কোনও মেয়ের নাম দিও।

আর হাতের লেখা?

অত কেউ লক্ষ করবে না।

কোন মেয়ের নাম দেব?

যে কোনও একটা। তোমার তো এত মেয়ে বন্ধু, তাদের যে কারুর নাম বসিয়ে দিয়ো।

ইন্দ্রজিৎ এবার হেসে ফেলল। হাসতে-হাসতে বলল, আমার অনেক মেয়ে বন্ধু বুঝি?

চন্দনা সূক্ষ্ম ঠাট্টার সুরে বলল, নেই? সেদিন রবীন্দ্রসদনে যে দেখলাম, তুমি ডান পাশে সিঁথি কাটা একটা মেয়ের সঙ্গে খুব হেসে-হেসে কথা বলছ?

কবে? ও, সে তো তপনের বোন ঝুমা। বিয়ে হয়ে গেছে। বাবা একজনের সঙ্গে একটু কথা বলেছি, তাতেই…

তুমি যে সুব্রতদার নামে এইরকম করে বলো?

ইন্দ্রজিৎ হোহো করে হেসে উঠল। মনে আর গ্লানি নেই। এখন সুব্রতদার ব্যাপারে কাটাকাটি হয়ে গেছে।

ইন্দ্রজিৎ বলল, শোনো, আমি চিঠির তলায় নাম দেব কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। আমি তো কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গানের দারুণ ভক্ত।

আমার ভালো লাগে সুচিত্রা মিত্রের।

যাই বলো, কতগুলো গান আছে, যা কণিকার গলায়…এরপর কিছুক্ষণ ওরা দুজনে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিষয়ে তর্কাতর্কি করল। সেই তর্ক শেষ হল চন্দনার গানে। চন্দনা গুনগুন করে গাইল, সকরুণ বেণু বাজায়ে যে যায় বিদেশি নায়ে…

একসময় ইন্দ্রজিৎও আস্তে-আস্তে গলা মেলাল। তার গানের গলা মন্দ নয়। দু-তিনটে ছেলে কাছ দিয়ে কয়েকবার ঘোরাঘুরি করছিল। তাদের দৃষ্টি ভালো নয়। তাঁরা চেঁচিয়ে-চেঁচিয়ে খারাপ কথা বলছে, নিজেদের মধ্যেই অবশ্য।

ইন্দ্রজিৎ উঠে পড়ে বলল, চলো।

চন্দনা উঠে পড়ে বলল, চলো।

চন্দনা উঠে এল। বেশ খানিকটা চলে আসার পর খেয়াল হল রুমালটা নিয়ে আসা হয়নি। সেখানেই পড়ে আছে।

চন্দনা বলল, আমি এখানে দাঁড়াচ্ছি। যাও নিয়ে এসো।

ইন্দ্রজিৎ দৌড়ে চলে গেল। ফিরে এল খালি হাতে। এসে বলল, ওটা গেছে! হাওয়ায় উড়ে নীচের ময়লা জলে পড়েছে দেখলাম।

তোমার বড্ড ভুলো মন। রুমালটা নতুন ছিল না?

যাক গে। ভারি তো একটা রুমাল।

তুমি এরকম জিনিসপত্তর হারাও। হোস্টেলে গিয়ে কী কী করবে? একা-একা থাকতে হবে।

একা কোথায়? এবার তিনশো আটাত্তর জন সিলেকটেড হয়েছে।

তা হলেও, তোমার চেনা তো কেউ নেই। তোমার বন্ধুরা তো কেউ এখানে ভরতি হয়নি।

দু-দিনেই অনেক বন্ধু হয়ে যাবে!

অনেক বন্ধু পেয়ে তারপর আমাকে ভুলে যাবে তো?

ইন্দ্রজিৎ আবার সেই চুম্বক আকৃষ্ট চোখে তাকাল চন্দনার দিকে। তার হাসিমাখা ঠোঁটে বলল, হ্যাঁ, ভুলে যাব। তোমাকে একদম ভুলে যাব। আর কোনওদিন মনে পড়বে না। তুমি খুশি হবে তো?

এবার চন্দনার পালা। সেও একইরকম আকৃষ্ট চোখে তাকিয়ে বলল, যেদিন তুমি আমাকে ভুলে যাবে, সেই দিনই আমি মরে যাব। দেখো, ঠিক সেই দিনই মরে যাব!

আর যদি কোনওদিন না ভুলি, তা হলে তুমি চিরকাল বেঁচে থাকবে? বলো?

ওরা সদ্য কৈশোর পেরিয়েছে। তাই অনায়াসেই এইরকম কথা বলতে পারে। ওদের চোখে পৃথিবীটা কত সুন্দর। ভবিষ্যৎ জীবনের কত সম্ভাবনা। সামান্য কথাতেই ওরা দুঃখ কিংবা আনন্দ পায়। ওদের অভিমানও খুব তীব্র।

চন্দনার হলুদ সিল্কের শাড়িটা মাঝে-মাঝে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে ভরতি হওয়ার পর থেকে চন্দনা নিয়মিত শাড়ি পরতে শুরু করেছে, এর আগে শুধু বিয়ে বাড়িতে শাড়ি পড়ে যেত। এখনও ভালো করে শাড়ি সামলাতে শেখেনি। আঁচলটা গা থেকে পরে গেলেই সে লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে। ইন্দ্রজিৎ তার দিকে তাকিয়ে হাসে। এক-একবার চোখ ফিরিয়ে নেয়, আবার তাকায়।

চন্দনা বলল, আমরা এদিকে কোথায় যাচ্ছি?

ইন্দ্রজিৎ বলল, বাঃ, মনে নেই? আজ তোমাকে খাওয়াব বলেছিলাম না!

চন্দনা ব্যস্ত হয়ে বলল, না, না, আজ থাক।

কেন?

অনেক দেরি হয়ে যাবে।

কিচ্ছু দেরি হবে না।

কেউ দেখে-টেখে ফেলবে। কেউ দেখবে না। আমি ওয়াটগঞ্জে একটা খুব নিরিবিলি চিনে রেস্তোরাঁ দেখে এসেছি। সেখানে কেউ যাবে না।

আজ থাক না বাবা।

ইন্দ্রজিৎ দাঁড়িয়ে পড়ে কড়া গলায় বলল, ঠিক আছে, আজ সারারাত ফিরব না, রাজি?

তুমি পারবে?

তুমি পারবে কিনা বলো?

আচ্ছা, দেখা যাক। আজ সারারাত রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরব।

হাঁটতে হাঁটতেই ওরা চলে এল একটা নিরিবিলি রেস্তোরাঁর কাছে। ওদের সৌভাগ্যবশত একটা কেবিন খালি ছিল।

সেখানে ঢুকে ইন্দ্রজিৎ এক গাদা খাবারের অর্ডার দিল। চন্দনার কোনও আপত্তিও শুনল না

বেয়ারা অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার পর ইন্দ্রজিৎ টেবিলের ওপর থেকে চন্দনার কোমল দক্ষিণ হাত তুলে নিল নিজের হাতে। তারপর বলল, তোমার হাতের পাঞ্জা ঠিক করমচার মতো লাল।

হাত ছাড়িয়ে নিয়ে চন্দনা বলল, এই, আমাকে ত্রিশটা টাকা দাও তো!

অবাক হয়ে ইন্দ্রজিৎ বলল, ত্রিশটাকা, কী হবে?

দাও না, দরকার আছে।

এখন?

হ্যাঁ।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ইন্দ্রজিৎ পয়সাটা বার করে দিল। চন্দনা নিজের হাতে ব্যাগ খুলে বার করল একটা রুমালের প্যাকেট। সেটা ইন্দ্রজিতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এতে ছখানা রুমাল আছে, আমি তোমায় ত্রিশ টাকায় বিক্রি করলাম।

তার মানে?

রুমাল কারুকে এমনি-এমনি দিতে নেই। জানো না?

যত সব কুসংস্কার।

চন্দনা এক ধমক দিয়ে বলল, রুমালগুলো হাতে নিয়ে একবার দেখলেও না পর্যন্ত? পছন্দ কি না বলো?

প্যাকেটটা হাতে নিয়ে ইন্দ্রজিৎ বলল, তুমি কেন শুধু-শুধু এগুলো কিনতে গেলে? আমার তো রুমাল আছে অনেক…

যেরকমভাবে হারাচ্ছ, দেখলাম তো।

খুব চমৎকার। যাক বাবা, খুব সস্তায় রুমাল পাওয়া গেল। মাঝে-মাঝে এরকম দিও আমাকে, কেমন?

আ-হা-হা।

এই শোনো, সেই জিনিসটা এনেছ তো?

এবার লজ্জায় একেবারে রক্তিম হয়ে গেল চন্দনার মুখ। সে মুখ নীচু করে বলল, না, আনিনি।

কেন?

লজ্জা করে।

ইন্দ্রজিৎ চটে উঠে বলল, তোমাকে এত করে বললাম…তবু তুমি আনলে না? দেখি তোমার ব্যাগ দেখি!

চন্দনা ব্যাগটা লুকোতে চায়। ইন্দ্রজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে সেটা জোর করে কেড়ে নিল। ব্যাগটা খুলতেই দেখতে পেল চন্দনার ছবি।

ছাদের ওপর কতগুলো ফুল গাছের টবের পাশে চন্দনা দাঁড়িয়ে আছে। চিবুক উঁচু করে দেখছে আকাশ। আঁচলটা উড়ছে হাওয়ায়।

গাঢ় চোখে ছবিখানার দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রজিৎ বলল, কে তুলেছিল ছবিটা?

সুব্রতদা। আরও অনেকের তুলেছিল।

এবার সুব্রতদার নাম শুনেও রাগ করল না ইন্দ্রজিৎ। খানিকটা উদার ভাবেই বলল, বেশ ভালো ছবি তোলেন না। অবশ্য, ছবির সাবজেক্ট যদি ভালো হয়…

টপ করে ছবিতে একটু চুমু খেয়ে ফেলল ইন্দ্রজিৎ। চন্দনা বলল, খুব অসভ্য হয়েছ, না?

তখন চন্দনার বাস্তব ঠোঁটে একটু ঠোঁট ছোঁয়াবার জন্য ইন্দ্রজিৎ ব্যাকুলতা বোধ করে। কেবিনের পরদার ফাঁক দিয়ে সে বাইরের দিকে তাকায়। আর কেউ তাদের লক্ষ করছে না তো?

ইন্দ্রজিৎ বসেছিল টেবলের বিপরীত দিকে। চন্দনার পাশে আর একটা চেয়ার খালি পড়ে আছে। ইন্দ্রজিৎ মিনতি করে বলল, চন্দনা, আমি তোমার পাশে ওইখানটায় গিয়ে বসব?

চন্দনা চোখ পাকিয়ে বলল, না!

তবু ইন্দ্রজিৎ উঠতে যাচ্ছিল, এই সময় বেরসিকের মতন বেয়ারা ঢুকল খাবার নিয়ে। তখন ইন্দ্রজিৎ এমন একটা ভাব দেখাল যেন প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট দেশলাই বার করার জন্যই তাকে উঠে দাঁড়াতে হচ্ছে। আবার বসে পড়ল ধপ করে।

চন্দনা বলল, সুপ ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খাও তো!

একটু বাদে চন্দনা দেখল, ইন্দ্রজিৎ বিশেষ কিছু খাচ্ছে না। খাবার নিয়ে নাড়াচাড়া করছে শুধু। চন্দনা আরও খাবার ইন্দ্রজিতের প্লেটে তুলে দিয়ে বলল, এই তুমি খাচ্ছ না যে?

আর কত খাব?

বাঃ, এত খাবার নষ্ট হবে না কি?

ইন্দ্রজিৎ হাসতে-হাসতে বলল, এরপর আমাকে কোথায় যেতে হবে জানো? বড়মামার বাড়িতে নেমন্তন্ন, সেখানে গিয়ে আবার খেতে হবে।

চন্দনা শিউরে উঠে বলল, এরপর তুমি আবার খাবে?

কী করব? সেখানে গিয়ে তো বলতে পারব না যে খেয়ে এসেছি!

তা হলে এখানে আজ এলে কেন? আমি বারণ করেছিলুম কত…

বেশ করেছি। আমার ইচ্ছে।

খাওয়া দাওয়া শেষ হওয়ার পর ইন্দ্রজিৎ দাম মিটিয়ে দিয়েছে। বেয়ারাকে উদার হাতে দিয়েছে বখশিস। চন্দনা আর দেরি করতে পারবে না, তক্ষুনি উঠবে। ব্যাগটা তুলে নিয়ে সে সবেমাত্র মুখ তুলেছে, ইন্দ্রজিৎ দ্রুত তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে গেল। কিন্তু ঠোঁটে ঠোঁট লাগার আগেই চন্দনা সরিয়ে নিলে মুখ।

ইন্দ্রজিৎ তার পরেই দ্রুত সরে গিয়ে পরদা তুলে বলল, এসো।

দোকান থেকে বেরুবার পর বেশ কিছুক্ষণ পর্যন্ত কেউ একটাও কথা বলল না। ইন্দ্রজিৎ ভয়ে ভয়ে তাকাচ্ছে চন্দনার দিকে। চন্দনা একবারও ইন্দ্রজিতের দিকে তাকায়নি।

ইন্দ্রজিৎ চন্দনার বাহু আলতোভাবে ছুঁয়ে বলল, তুমি রাগ করেছ।

চন্দনা মুখ না তুলেই বলল, আমার কান্না পাচ্ছে।

কেন?

তুমি কেন এরকম করলে?

ইন্দ্রজিৎ এবার চন্দনার হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলল, তুমি তো সম্পূর্ণ আমার। তুমি আমার না?

চন্দনা চুপ।

বলল, তুমি আমার না?

হ্যাঁ।

তাহলে? আমি তোমাকে একটু ইচ্ছে মতন আদর করতেও পারব না? সেটা কি দোষ?

একটুক্ষণ থেমে থেকে চন্দনা বলল, এরকমভাবে নয়! আমার ভীষণ লজ্জা করে।

চন্দনার গলায় এমন একটা ব্যাকুলতা ছিল যা ইন্দ্রজিৎকে তৎক্ষণাৎ স্পর্শ করল। সে অনুতপ্তভাবে বলল, আচ্ছা কথা দিচ্ছি, এরকম আর কক্ষণও করব না। লোকজনের সামনে তোমাকে লজ্জায় ফেলব না!

২.

ইন্দ্রজিতের বাবা ওকে নিজে গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবেন, ইন্দ্রজিতের এটা একেবারেই পছন্দ নয়। সে বড় হয়েছে, সে কি একা যেতে পারে না? অ্যাডমিশান টেস্টের সময় তো দাদা গিয়েছিলই সঙ্গে। এখন তো আর কারুর যাওয়ার দরকার নেই। ইন্দ্রজিৎ একথা মাকে কতবার বলেছে। কিন্তু বাবা যাবেনই।

বাবার মুখের ওপর কোনও কথা বলার সাহস ইন্দ্রজিতের নেই। বাধ্য হয়ে তাকে যেতে হল।

দুপুরে বাড়ি থেকে সকাল-সকাল খেয়েই বেরিয়েছিল ওরা। ওখানকার স্টেশনে পৌঁছল বিকেল চারটের সময়। বাবা স্টেশন থেকে একগাদা ফল ও কেক কিনে নিলেন। প্রথম দিন হোস্টেলে কী খেতে দেয়-না-দেয়, তার ঠিক কী!

তারপর একটা সাইকেল রিকশা নিলেন। স্টেশন থেকে কলেজ বেশদূরের রাস্তা। সুটকেশ বেডিং সমেত দুজন সেই একই রিকশা চাপায় বেশ জররজং অবস্থা। ইন্দ্রজিৎকে পা গুটিয়ে বসতে হয়েছে।

খানিকটা যাওয়ার পর বাবা বললেন, খোকা তোকে একটা কথা বলব শুনবি?

ইন্দ্রজিৎ বাবার মুখের দিকে তাকাল।

বাবা বললেন, সব সময় মনে রাখবি, তোকে ভালো রেজাল্ট করতে হবে। তোকে বড় ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে। অনেক কষ্ট করে তোকে লেখাপড়া শেখাচ্ছি!

ইন্দ্রজিৎরা ধনী নয়, সাধারণ সংক্ষিপ্ত সংসার। তার বাবা অফিসে মোটামুটি উঁচু পদে চাকরি করেন। রিটায়ার করার দিন এগিয়ে আসছে। ইন্দ্রজিৎকে হোস্টেলে রেখে পড়াবার খরচ…ইন্দ্রজিৎ তা বোঝে।

সে চুপ করে রইল।

বাবা আবার বললেন, ছোটবেলা আমারও খুব ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। আমার বাবা

আমাকে পারেননি, সাধ্যে কুলোয়নি। তাই খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। ছোট ছিলাম তো, অত বুঝিনি। তারপর ভেবেছিলাম, আমার কোনও ছেলে হলে, তাকে আমি ইঞ্জিনিয়ার করবই। তোর দাদা নিজে ইচ্ছে করেই আর্টস পড়ল…সায়েন্সে মাথা নেই। এখন তোর ওপর ভরসা।

ইন্দ্রজিৎ মুখে কিছু বলল না। মনে-মনে বলল, বাবা, আমি আপনার কথা রাখব। আপনি দেখবেন, আমি একদিন খুব বড় হব।

হোস্টেলে অনেক ছেলে ফাঁকি-টাঁকি দেয়। তাদের সঙ্গে মিশবি না। আবার ভালো ছেলেও আছে। যার ইচ্ছে থাকে, সে ঠিক পড়াশুনো করতে পারে। আর সব সময় শরীরের যত্ন নিবি!

আর-একটা রিকশা ঠিক এদের পেছনে আসছিল। তাতেও একজন প্রৌঢ় লোকের সঙ্গে ইন্দ্রজিতের বয়েসি একটি ছেলে। পায়ের কাছে বাক্স বিছানা। একই কলেজের ছেলে বলে মনে হল।

কলেজের কম্পাউন্ডের কাছে পৌঁছে রিকশা থেকে নামার পর সেই ছেলে নিজে থেকেই আলাপ করতে এল ইন্দ্রজিতের সঙ্গে। সে জিগ্যেস করল, আপনার কি সিভিল না ইলেকট্রিকাল?

ইন্দ্রজিৎ বলল, সিভিল।

ছেলেটি বলল, আমারও তাই। ভালোই হল, একইসঙ্গে থাকা যাবে। আমার নাম অরূপ বসু। ইন্দ্রজিৎ নিজের নাম জানাল।

অরূপ ছেলেটি রোগ পাতলা, গায়ের রং অসম্ভব ফরসা। মুখখানা দেখলে বেশ বুদ্ধিমান বলে মনে হয়। সে এসেছে বোলপুর থেকে। অল্পক্ষণের মধ্যেই তাদের ভাব হয়ে গেল।

এদিকে অরূপের বাবার সঙ্গেও আলাপ জমে উঠল ইন্দ্রজিতের বাবার। এক ঘণ্টা পরে ট্রেন, ওরা একই সঙ্গে ফিরবেন।

একটু বাদেই জানা গেল যে অরূপ আর ইন্দ্রজিতের একই জায়গায় থাকবার জায়গা হয়নি। অরূপের ঘর আবুল কালাম আজাদ ওয়ার্ডে আর ইন্দ্রজিতের সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ওয়ার্ডে। সুপারিন্টেন্ডেন্টের কাছে দুই পিতাই অনেক করে অনুরোধ করলেন, যাতে ওদের এক ঘরে না হোক এক বাড়িতে থাকতে দেওয়া হয়।

তিনি মাথা নেড়ে বললেন, না, সব নতুন ছেলেদের এক সঙ্গে থাকতে দেওয়ার নিয়ম নেই। নতুন পুরোনোদের মিলেমিশে থাকাই নিয়ম।

ইন্দ্রজিতের বাবা ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে এলেন তার ঘর দেখতে। ঘর বেশ ভালোই, তিনতলার ওপরে, যথেষ্ট আলো হাওয়া, দক্ষিণ দিকে বিরাট জানালা।

কলেজ এখন ছুটি। দুদিন পরে ক্লাস আরম্ভ হবে। তাই বাইরের ছেলেরা অনেকে আসেনি। হোস্টেলটা নিস্তব্ধ মনে হচ্ছিল।

সিঁড়ির কাছে দুটি ছেলেকে দেখে বাবা বললেন, বাবা, আমার ছেলেটাকে রেখে গেলাম, তোমরা একটু দেখো। একথা শুনে এমন লজ্জা করল ইন্দ্রজিতের। সে কি বাচ্চা ছেলে না কি! বাবাদের নিয়ে আর পারা যায় না।

ছেলে দুটি খুবই সম্ভ্রমের সঙ্গে বলল, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই! আপনি কিছু চিন্তা করবেন না। ওর কোনও অসুবিধে হবে না।

বাবা বললেন, তোমরা সব রয়েছ, বড়ভাইয়ের মতন।

ইন্দ্রজিৎ বাবাকে পৌঁছে দিয়ে এল গেট পর্যন্ত। তিনি অরূপের বাবার সঙ্গে এক রিক্সায় চলে গেলেন। ইন্দ্রজিৎ ফিরে এল নিজের ঘরে। সন্ধে হয়ে এসেছে। বিকেলে আর কিছু খেতে দেবে না। বোধহয়। সঙ্গে কিনে আনা কমলালেবু খেতে লাগল খোসা ছাড়িয়ে।

ঘরটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। বারান্দার এক কোণে, ছোট, নিরিবিলি। ইন্দ্রজিৎ এর আগে কখনও একা ঘরে শোয়নি। তার বহুদিনের শখ একা থাকার। বাবার কথা রাখবে সে, এই কটা বছর খুব মন দিয়ে পড়াশুনো করবে।

এইসব জায়গায় হঠাৎ যেন ঝুপঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসে। দরজার পাশে সুইচ, সে আগেই দেখে রেখেছিল। আলো জ্বালতে এসে দারুণ জোরে একটা ধাক্কা খেল। যেন ভূতে ঠ্যালা মারল তাকে।

ইন্দ্রজিৎ চমকে গিয়ে ছিটকে পড়ে যাচ্ছিল, কোনওক্রমে সামলে নিল নিজেকে। ব্যাপারটা সে বুঝতে পেরেছে, ইলেকট্রিক শক। পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বেলে দেখল, সুইচের ওপরের ঢাকনাগুলো কে খুলে নিয়ে গেছে। একটু আগে সে দেখেছিল না? কিংবা ভুল দেখেছে?

এরকম ভোলা সুইচ রাখা খুব বিপজ্জনক। হোস্টেলের সুপার এ সব দেখেন না? প্রথম দিন এসেই কি ইন্দ্রজিৎ কমপ্লেন করবে?

কাঠের চেয়ারটা টেনে এনে ইন্দ্রজিৎ তার ওপর দাঁড়িয়ে সুইচ টিপে আলো জ্বালল। তারপর দরজা বন্ধ করে পোশাক বদলাতে লাগল সে।


তক্ষুনি দরজায় টকটক আওয়াজ। তাড়াতাড়ি প্যান্টের বোতাম আটকে ইন্দ্রজিৎ দরজা খুলল। বাইরে সাত আটজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে একটু আগে সিঁড়িতে দেখা সেই দুজনও রয়েছে।

সেই দুজনের মধ্যে একজন বলল, এই যে ভাই, তোমার সঙ্গে আলাপ করতে এলাম।

ইন্দ্রজিৎ বিনীতভাবে বলল, আসুন, আসুন!

ইন্দ্রজিৎ দেখল, সেই ছেলেদের অনেকের হাতে একটি করে টর্চ, দু-একজনের হাতে টেনিস স্টিক।

বোধহয়, এখানে প্রায়ই আলো নিভে যায়।

লম্বামতন একটি ছেলে বলল, তোমার বাবা বলে গেছেন, শুনেছ তো, আমরা তোমার দাদা হই? আমাদের নামগুলো বলছি, শুনে নাও! আমার নাম সত্যেন, এ ধনঞ্জয়, এ নায়ার, ওই যে পৃথীপাল, ওর নাম সুলেমান, ও ফিরদৌস, আর ওই সুব্রত। এবার বলে যাও তো তুমি কার কি নাম…দেখি কীরকম মনে রাখতে পার?

একবার মাত্র শুনেই এতগুলো নাম মনে রাখা শক্ত। তবু ইন্দ্রজিৎ খুব চেষ্টা করে বলবার চেষ্টা করল।

একটা ভুল হল তার।

সত্যেন নামের ছেলেটি বলল, এক পয়েন্ট লস। পৃথীপাল, যার নাম ইন্দ্রজিৎ ঠিক বলতে পারেনি, সে বলল, আই হ্যাভ গেইনড ওয়ান পয়েন্ট।

ইন্দ্রজিৎ ব্যাপারটা বুঝতে পারল না।

সত্যেন বলল, শোনো, এখানে নতুন এসেছ, কয়েকটা নিয়মকানুন জানতে হবে। সকলের সঙ্গে মিশতে হবে, সকলের কথা শুনতে হবে। এখানে সারা ভারত থেকে ছাত্র আসে, এখানে কেউ। একা-একা থাকে না। আর-একটা কথা, ভেতো বাঙালি হয়ে থাকলে কোনওদিন ইঞ্জিনিয়ার হতে পারবে না। অ্যাডমিশন টেস্টে পাশ করলেও আরও কয়েকটা পরীক্ষা দিতে হবে।

ইন্দ্রজিৎ বলল, নিশ্চয়ই। আপনারা যা বলবেন, আমি তাই শুনব!

ঠিক আছে। বসো, ওই চেয়ারটায়। ইন্দ্রজিৎ চেয়ারে বসা মাত্র একজন হকি স্টিকের খোঁচা দিয়ে নিভিয়ে দিল আলো। সঙ্গে-সঙ্গে সাত আটটা টর্চের আলো তার চোখে।

ইন্দ্রজিৎ দু-হাতে চোখ ঢেকে ফেলল।

একজন বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে হুকুম দিল, চোখ খোলো!

ইন্দ্রজিৎ হাত সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। চোখ একেবারে ঝলসে যাচ্ছে যেন। বলল, পারছিনা!

একজন বলল, এ কি শুরুতেই কাত? চোখ খোল শালা।

ইন্দ্রজিৎ হাত সরিয়ে চোখ পিটপিট করতে লাগল।

নাম কী?

ইন্দ্রজিৎ সরকার।

বাবার নাম?

নিকুঞ্জলাল সরকার।

ঠাকুরদার নাম?

গোকুলবিহারী সরকার।

ঠাকুরদার বাবার নাম?

ইয়ে মানে…

এক পয়েন্ট। শালা, বাপের ঠাকুরদার নাম আমরাও কেউ জানি না। তুই বানিয়ে বলতে পারলি না? আচ্ছা, এবার বল, এ টুদা পাওয়ার এন ইনটু এ টুদা পাওয়ার এন কত হয়?

জানি না।

কিছুই হয় না। সেটুকুও জানিস না। আর এক পয়েন্ট। আচ্ছা বল, ইনফ্রাস্ট্রাকচার কাকে বলে?

কোনও কিছু প্রোডাকশনের সঙ্গে যা যা দরকারি, যেমন ট্রান্সপোর্ট, ইলেকট্রিসিটি, রাস্তা। ঠিক আছে, ঠিক আছে। এবার বল, আমার বাবা একটা বাঞ্চোত!

কী?

কানে শুনতে পাস না?

ও কথা আমি বলব কেন?

আমরা হুকুম করছি, তাই বলবি!

না!

সবাই এক সঙ্গে হোহো করে হেসে উঠল। টর্চ হাতে নিয়ে সবাই এগিয়ে আসতে লাগল আরও কাছে।

ইন্দ্রজিৎ ভয় পেয়ে চোখ ঢাকল। মনে-মনে তবু বলল, আমি ভয় পাব না! আমি ভয় পাব না কিছুতেই।

সত্যেন জোর করে ইন্দ্রজিতের চোখ থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, তুই প্যাঁচা নাকি রে, যে এইটুকু আলো সইতে পারিস না! এবার পৃথীপাল যা বলবে তোকে শুনতে হবে।

পৃথীপাল তার হাঁটুর পেছন দিকে একটা লাথি মেরে বলল, আরে ইয়ার, এই সা, এই সা…

ইন্দ্রজিতকে একটা অদৃশ্য চেয়ারের ওপর বসার ভঙ্গি করতে হল। কিন্তু এইভাবে বসে থাকা কী।

অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক, হাঁটু হুমড়ে সে একবার পড়ে যাচ্ছে আর দুপাশ থেকে পৃথীপাল আর সুলেমান তার কান ধরে টেনে তুলছে।

ইন্দ্রজিৎ একসময় চেঁচিয়ে বলল, আমি আর পারছি না।

চোপ! পারিব না এ কথাটি বলিও না আর!

একটু বাদে নায়ার এসে বলল, এবার আমার টার্ন। ছেড়ে দাও!

নায়ার দক্ষিণ ভারতীয় হলেও বাংলা জানে ভালো। সে ইন্দ্রজিতের নাকটা ধরে মুচড়ে দিয়ে বলল, বেশ লম্বা আছে তো! দেখি কীরকম নাক খৎ দিতে পারো! যাও, দরজার কাছে যাও। ওইখান থেকে আমার পা পর্যন্ত।

ইন্দ্রজিৎ বলল, কেন? নাক খৎ দেব কেন? ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার সঙ্গে নাক খৎ দেওয়ার সম্পর্ক কী?

সত্যেন বলল, এখানে কোনও প্রশ্ন চলবে না। যে যা বলবে, করতে হবে।

কে একজন যেন জোরে এক লাথি কষাল ইন্দ্রজিতের পেছনে। চেঁচিয়ে বলল, শালা, দেরি করিস কেন?

ফের অন্যদিক থেকে এক লাথি।

ইন্দ্রজিতের মাথার মধ্যে আগুন ধরে গেল। তার ইচ্ছে হল, সেও এলোপাথাড়ি হাত-পা ছোঁড়ে। কিন্তু এতগুলো বড়-বড় ছেলের সঙ্গে সে একা পারবে কী করে?

বাধ্য হয়ে ইন্দ্রজিতকে নাকে খৎ দিতেই হল। একবার না পাঁচবার। দরজার কাছ থেকে নায়ারের পায়ের কাছ পর্যন্ত আসতে হবে। এর মধ্যে একবার মাথা তুলে ফেললেই আবার গোড়া থেকে।

এইরকম আরও কতক্ষণ চলত, তার ঠিক নেই। একসময় খাবারের ঘণ্টা বেজে উঠল। নিষ্কৃতি পেয়ে গেল ইন্দ্রজিৎ।

সবারই খিদে পেয়েছে। খাবারের ঘণ্টা বাজলে কেউ আর এক মিনিটও দেরি করতে চায় না।

সত্যেন জিগ্যেস করল, এই, তুমি খাবারের ঘর চেনো?

ইন্দ্রজিৎ চেনে না।

সত্যেন বলল, চলো, আমাদের সঙ্গে চলো।

খাবারের ঘরে বিরাট লম্বা টেবিল। সবগুলো চেয়ার ভর্তি হয়নি। অনেক ছেলে এখনও বাড়ি থেকে ফেরেনি। নতুন ছেলেরাও আর কেউ আসেনি এই হলে। নতুনের মধ্যে ইন্দ্রজিৎ একা।

ইন্দ্রজিৎ চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে চাইছে, একজন মোটা মতন ছেলে তার কাঁধ ধরে বলল, এই দাঁড়াও। তারপর সে অন্যদের জিগ্যেস করল, এ কি আই টি মিক্সচার খেয়েছে?

সত্যেন, নায়ার, পৃথীপাল এরা এক সঙ্গে বলে উঠল, না, এখনও খায়নি!

মোটা ছেলেটি বলল, বাঃ, মিক্সচার খায়নি, তার আগেই খেতে বসল যে। এই দাঁড়াও তুমি, আমি মিক্সচার বানিয়ে আনছি।

সে একটা গেলাস নিয়ে চলে গেল। একটু বাদেই ফিরে এল ভরতি গেলাস নিয়ে। কী দিয়ে মিক্সচার বানিয়েছে কে জানে, অদ্ভুত তার রং।

আর-একজন তার হাত থেকে গেলাসটাকে নিয়ে খানিকটা নুন আর মরিচ মিশিয়ে দিল। আর একজন নিজের চটি জুতোটা তুলে গেলাসের ধারে ঘষে মিশিয়ে দিল খানিকটা ধুলো।

এবার সেটা ইন্দ্রজিতকে খাওয়ানো হবে। আর একটি ছেলে লাফিয়ে উঠে বলল, দাঁড়া, আর একটু বাকি আছে।

গেলাসটা হাতে নিয়ে সে সকলের চোখের সামনে প্যান্টের বোতাম খুলে খানিকটা হিসি করে দিল গেলাসের মধ্যে সত্যিই। তারপর হাসতে-হাসতে গেলাসটা ইন্দ্রজিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নে শালা, খা!

সব দেখেশুনে ঘেন্নায় ইন্দ্রজিতের বমি আসছিল। সে কঠিন মুখ করে বলল, না, আপনারা কি ভদ্রলোকের ছেলে?

সবাই একসঙ্গে হোহো করে হেসে উঠল। যেন একটা দারুণ মজার কথা।

মোটা মতন ছেলেটা বলল, ওরে বাবা! কত ভদ্দর লোক এসেছে রে! এত বড় ভদ্দরলোক তো এখানে চলবে না! নাও ভাই, এটা খেয়ে জাতে ওঠো।

ইন্দ্রজিৎ মুখ ফিরিয়ে নিল।

তখন তিন চারজন মিলে চেপে ধরল তাকে। জোর করে খাওয়াবে। ইন্দ্রজিৎ ঠোঁটে তালা দিয়ে রেখেছে। ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে গেল। ইন্দ্রজিতের গায়ে জোর আছে, কিন্তু অত জনের সঙ্গে পারবে কেন? ওরা তার ঠোঁটের কাছে গেলাসটা চেপে ধরে আছে।

ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়াতে গিয়ে ইন্দ্রজিৎ পড়ে গেল মাটিতে। আত্মরক্ষার জন্য তাড়াতাড়ি ঢুকে পড়ল টেবিলের নীচে।

তার ফলে আরও বিপদে পড়ল, টেবিলের তলা থেকে সে আর বেরুতেই পারল না, অন্য ছেলেরা যে যার চেয়ারে বসে পড়েছে, ইন্দ্রজিৎ যে দিক দিয়ে বেরোতে যায়, অমনি সেদিকে একজন তাকে লাথি মারে। খেলাচ্ছলে মারা নয়, রীতিমতো জোরে, তার চোখে মুখে যেখানে সেখানে লাগতে পারে।

ইন্দ্রজিৎ একটা কুকুরের মতন টেবিলের তলায় এদিক ওদিক ঘুরতে লাগল আর লাথি খেতে লাগল। তার কান্না এসে যাচ্ছে। কিন্তু সে জানে, কেঁদে ফেললে এরা আরও পেয়ে বসবে।

একবার সে বলল, আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে এবার ছেড়ে দিন!

দু-তিনটি ছেলে বলল, যথেষ্ট হয়েছে। এই, এবার ছেড়ে দে। একদিনে বেশি হয়ে যাচ্ছে।

মোটা ছেলেটি বলল, আচ্ছা, ছেড়ে দিচ্ছি। এদিক দিয়ে বেরিয়ে এসো।

ইন্দ্রজিৎ একটু মুখ বের করতেই সে জিগ্যেস করল, এবার মিক্সচার খাবে তো?

আমি পারব না, কিছুতেই পারব না।

তবে খা শালা, লাথি খা।

মোটা ছেলেটি দারুণ জোরে লাথি মারল ইন্দ্রজিতের মুখে। তার নাক দিয়ে ঝরে পড়ল কয়েক ফোঁটা রক্ত।

তার ইচ্ছে হল, ওই মোটা ছেলেটির পা কামড়ে দেয়।

সেরকম কিছু করল না। সে টেবিলের নীচে শুয়ে রইল চিত হয়ে। সে আর এখান থেকে বেরুবে না। হঠাৎ ছেলেদের মধ্যে কী যেন একটা পরিবর্তন এসে গেল। সত্যেন নীচু হয়ে টেবিলের তলায় মুখ ঝুঁকিয়ে বলল, কী হল? এসো।

না, আমি এখানেই থাকব।

সত্যেন হাত ধরে টেনে বের করল ইন্দ্রজিতকে। নরম গলায় বলল, ছিঃ এতে রাগ করতে আছে? এমনি একটু ইয়ার্কি ঠাট্টা হচ্ছে।

সত্যেন নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে দিল ইন্দ্রজিতের মুখ। তাকে চেয়ারে বসানো হল।

অন্য ছেলেরা আগ্রহ করে তার প্লেটে তুলে দিল খাবার।

সত্যেন বলল, ভালো করে পেট ভরে খাও। যা লাগবে, চেয়ে নেবে, লজ্জা করবে না। এখানে তো আর মা নেই যে সেধে-সেধে খাওয়াবে! লজ্জা করলেই মরবে।

তারপর একটু নীচু গলায় মিষ্টি করে সত্যেন বলল, এক্ষুনি সুপারিটেন্ডেন্ট আসছে। তাকে যদি কোনও নালিশ করো, তাহলে তোমার সারা গা ব্লেড দিয়ে চিরে সেখানে নুন ছিটিয়ে দেওয়া হবে, বুঝলে?

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হোস্টেলের সুপার এসে ঢুকলেন। বেশ হষ্টপুষ্ট সদাশয় চেহারা। নাকের নীচে মোটা গোঁফ।

সুপার জিগ্যেস করলেন, নতুন ছেলেটি কোথায়?

কয়েকজন বলল, ওই যে স্যার, ওই যে!

সুপার ইন্দ্রজিৎকে জিগ্যেস করলেন, তোমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

ইন্দ্রজিৎ একটুক্ষণ চুপ করে রইল। সে বুঝতে পারল, অন্যরা সকলেই তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে নিশ্বাস দমন করে বলল, না।

সুপার বললেন, তোমার সব দাদারা রয়েছেন। কিছু অসুবিধা হলে সিনিয়ার ছেলেদের বলবে, তারাই সব ব্যবস্থা করে দেবে।

সত্যেন এবং আরও কয়েকজন ছেলে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার, আমরা তো আছি। আমরাই সব দেখাশুনো করব। আপনি চিন্তা করবেন না।

সুপার যেটুকু সময় রইলেন, সেসময় সকলেই খাওয়ায় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কোনও কথা নেই, শুধু খাওয়ার শব্দ।

সুপার চলে যাওয়ার পর মোটা ছেলেটি উঠে গিয়ে দরজার কাছে এসে দেখে এল। বলল, এ ছেলেটা স্যারকে কিছু বলেনি, সেইজন্য একে একটা প্রাইজ দেওয়া উচিত।

তারপর ইন্দ্রজিতকে সাবধান হওয়ার সুযোগ না দিয়ে সেই গেলাসের মিক্সচার ঢেলে দিল তার মাথায়। সেই নোংরা জল গড়িয়ে পড়ল ইন্দ্রজিতের খাওয়ার প্লেটে। তার খাওয়া তখন অর্ধেকও শেষ হয়নি।

সকলে হেসে এ ওর গায়ে গড়িয়ে পড়তে লাগল। দু-একজন শুধু বলল, যাঃ! ছেলেটাকে খেতে পর্যন্ত দিলি না! কিন্তু তাদের কথা চাপা পড়ে গেল অন্যদের কথায়।

ইন্দ্রজিতের মনে হল, সে একটা শত্ৰুপুরীতে বসে আছে। এরকম নিষ্ঠুর ছেলের দল সে আগে কখনও দেখেনি। সে অপমান আর অভিমান মেশানো গলায় বলল, আপনারা এতে কী আনন্দ পান? ঠিক আছে, আরও যা খুশি করুন! আমাকে মারুন!

মোটা ছেলেটি বলল, পরের বছর তুমিও নতুন ছেলেদের নিয়ে আনন্দ করবে। চিন্তা কী?

একে আনন্দ বলে? আপনাদের লজ্জা হয় না?

না, ভাই, আমাদের লজ্জা হয় না। ন্যাংটো হলেও আমাদের লজ্জা হয় না! তুমি ন্যাংটো হও, তাও আমরা লজ্জা পাব না।

আপনাদের দিকে তাকাতেই ঘেন্না হচ্ছে আমার। আপনারা পড়াশুনা করতে এসেছেন, না…

ইন্দ্রজিতের কথা শেষ হল না। একজন বলিষ্ঠ ছেলে এসে বাঁ-হাতে তার কলার চেপে রুক্ষ গলায় বলল, এই খোকা, এখনও ম্যানার্স শেখোনি? জানোনা, সিনিয়ারদের মুখে-মুখে কথা বলতে নেই!

অন্য একটি ছেলে বলল, এখনও যে ব্রেন ওয়াশিং হয়নি। চল, ব্রেন ওয়াশিং করিয়ে দিই।

তিন-চারজন ইন্দ্রজিতকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল বাথরুমে। ইন্দ্রজিতের মাথাটা ঠুসে ধরল কমোডের মধ্যে। ইন্দ্রজিৎ অনেক লড়াই করেও ছাড়া পেল না। একজন চেন টেনে দিতেই কমোডের নোংরা জলে ইন্দ্রজিতের মাথা ভিজে গেল।

সেই রাতে সাবান মেখে চান করেও ইন্দ্রজিতের ঘেন্না যায় না। সঙ্গে এক কৌটো পাউডার এনেছিল, সেই পাউডার শুধু গায়ে নয়, চুলের মধ্যেও ঢেলেছে। সাদা চুলে তাকে দেখাচ্ছে বুড়ো মানুষের মতন।

বিছানায় কাঠ হয়ে শুয়ে আছে ইন্দ্রজিৎ। ঘুম আসছে না। হোস্টেলে নতুন ছেলেদের ওপর র‍্যাগিংয়ের কথা সে শুনেছিল। রাগে তার গা জ্বলছে। ইচ্ছে করছে, কাল ভোরবেলাই এখান থেকে চলে যেতে। কিন্তু না, যাওয়া চলবে না। তাকে ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। যত কষ্টই হোক। তার ওপর অনেকে আশা করে আছে। ফিরে গিয়ে সে চন্দনাকে কী বলবে? চন্দনার কথা ভাবতে-ভাবতেই একটু বাদে তার ঘুম এসে গেল।

পরদিন সকালে উঠে ইন্দ্রজিৎ স্যুটকেশ খুলে তার সব বইপত্র বের করেছে। এমনসময় চার পাঁচজন ছেলে এসে ঢুকল তার ঘরে।

ওদের দেখেই ইন্দ্রজিৎ শঙ্কিত হয়ে উঠল। আবার কী শুরু হবে কে জানে!

ওদের মধ্যে সত্যেন আর সেই মোটা মতন ছেলেটিও আছে।

সত্যেন জিগ্যেস করল, কী, কাল রাত্রে ঘুম হয়েছিল তো?

ইন্দ্রজিৎ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।

এর মধ্যে একটা রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হবে। রেডি থেকো!

অন্য একজন বলল, সেটা যে-কোনও রাত হতে পারে!

মোটা ছেলেটি বলল, দেখি কী-কী জিনিসপত্র এনেছ?

তারা ইন্দ্রজিতের কাছ থেকে স্যুটকেসটা কেড়ে নিয়ে গোল হয়ে বসল মাটিতে। জামাকাপড়গুলি টেনে-টেনে বের করতে লাগল।

স্যুটকেসের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা ছিল এক খণ্ড, সেটা তুলে নিয়ে একজন বলল, এ কী, কবিতা?

আরেকজন বলল, খুব আঁতেল মনে হচ্ছে?

সত্যেন বলল, তুমি কি শান্তিনিকেতনের বদলে ভুল করে এখানে চলে এসেছ?

ইন্দ্রজিতের মনে হল, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্রের পক্ষে কবিতা পড়া বুঝি সত্যিই অন্যায়। সে লজ্জায় পড়ে গিয়ে দুম করে একটা মিথ্যে কথা বলে দিল, ওটা আমার দাদার বই, ভুল করে চলে এসেছে!

কিন্তু ইন্দ্রজিতের লজ্জা পাওয়ার এখনও অনেক বাকি ছিল।

ওরা ঘাঁটাঘাঁটি করে ইন্দ্রজিতের সব জিনিসপত্র বার করে ফেলল। ইন্দ্রজিৎ কক্ষণও অন্যের জিনিসে এভাবে হাত দিত না। কিন্তু ওরা এসব মানে না। স্যুটকেসের পকেট থেকে অন্য। কাগজপত্রের সঙ্গে বেরিয়ে গেল চন্দনার ছবিটা।

একজন সেটা ছোঁ মেরে তুলে নিল। সঙ্গে-সঙ্গে শিস দিয়ে বলল, আরে মাইরি, দারুণ জিনিস! ইন্দ্রজিৎ লাফিয়ে উঠে বলল, দিন, ওটা শিগগির আমাকে দিন।

কিন্তু যে ছেলেটা ছবিটা নিয়েছে, সে ইন্দ্রজিতের চেয়ে অনেক লম্বা। সে হাতটা উঁচু করে বলল, দাঁড়াও, দাঁড়াও! এটা কি তোমার দাদার জিনিস না কি! ভুল করে চলে এসেছে।

আপনারা পরের জিনিসে হাত দেন কেন?

ইন্দ্রজিতের কথা কেউ গ্রাহ্যই করল না। লম্বা ছেলেটি বলল, দারুণ রে! অনেকটা তনুজার মতন দেখতে না?

মোটা ছেলেটি বলল, না, বরং মীনা কুমারীর টাইপ।

সত্যেন ইন্দ্রজিতকে জিগ্যেস করল, মেয়েটার কী নাম ভাই। তোমার বন্ধুর বোন না বোনের বন্ধু?

ইন্দ্রজিৎ আরক্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইল, কোনও উত্তর দিল না।

লম্বা ছেলেটি সশব্দে ছবিটায় একটু চুমু খেয়ে বলল, আঃ।

মোটা ছেলেটি বলল, এই আমায় দে! আমায় দে একবার।

ইন্দ্রজিতের চোখ দিয়ে আগুন বেরুচ্ছে যেন। ওরা চন্দনাকে অপমান করছে! সে গোঁয়ারের মতন ছুটে গিয়ে এক ঘুষি মারল লম্বা ছেলেটির নাকে। ঘুষিটা বেশ জোরেই হয়েছিল। ছেলেটা উঃ করে নাক চেপে ধরল।

তারপর সে এক ল্যাং দিয়ে ইন্দ্রজিতকে ফেলে দিল মাটিতে। ইন্দ্রজিতের পিঠের ওপর চেপে বসল। মোটা ছেলেটিও বসল আর-এক দিকে। তারপর বলল, দ্যাখ শালা, তোর মালকে নিয়ে আমরা এখন কী করি। একলা-একলা মালবাজি করবি!

সেই লম্বা ছেলেটি, যার নাম অনুপম, সে ছবিটার ঠোঁটে, গলায় এবং আরও নীচে এমনভাবে ঠোঁট ঘষতে লাগল, যেন চন্দনাকে কামড়াচ্ছে। চন্দনার ব্লাউজে লেগে গেল তার লালা। সেইসঙ্গে যেসব কথা উচ্চারণ করতে লাগল, তা বলা যায় না।

ইন্দ্রজিৎ প্রাণপণে চেষ্টা করতে লাগল উঠে দাঁড়াবার। কিন্তু সে অসহায়। খানিক বাদে কে যেন সত্যেনের নাম ধরে ডাকতেই ওরা সবাই একসঙ্গে চলে গেল ঘর ছেড়ে।

ইন্দ্রজিৎ আস্তে-আস্তে উঠে দাঁড়াল। চন্দনার ছবিখানা মোচড়ানো অবস্থায় পড়ে আছে। সেটা তুলে নিয়ে ইন্দ্রজিৎ ছবিটাকে সমান করার চেষ্টা করতে লাগল। তারপর অনেকক্ষণ সেটার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে।

ইন্দ্রজিৎ মনে-মনে বলছে, তুমি আমার ওপর রাগ করেছ? কতগুলো নোংরা হাত তোমাকে ছুঁয়েছে। ওরা তোমার সম্পর্কে নোংরা কথা বলেছে। আমি বাধা দিতে পারিনি। তুমি রাগ করেছ আমার ওপরে? তুমি সব বুঝতে পারবে না?

ইন্দ্রজিৎ দেখল, ছবির মধ্যে চন্দনার হাসিটা একইরকম আছে। ছবিখানা হাতে নিয়ে সে জানলা দিয়ে বাইরে তাকাল। যেন এখান থেকেই কলকাতা পর্যন্ত দেখতে পাবে। ইন্দ্রজিৎ আবার মনে মনে বলল, তুমি কোনওদিন আমাকে ভুল বুঝো না।

যাতে ওরা আবার এই ছবিখানা নিয়ে কোনওরকম নোংরামি না করতে পারে, সেইজন্য সে ছবিখানা কুচি-কুচি করে ছিঁড়ে ফেলে দিল বাইরের মাঠে। ছবির দরকার কী! চোখ বুজলেই তো সে চন্দনাকে দেখতে পায়।

এরপর আরও চার-পাঁচদিন ধরে ইন্দ্রজিতের ওপর এইরকম অত্যাচার হতে লাগল। অত্যাচার কিংবা খেলা, একদিন সারারাত ধরে ওদের অনেক হুকুম পালন করতে হল। উচ্চারণ করতে হল ওদের শেখানো অসভ্য কথা। ইন্দ্রজিৎ আর কিছুরই প্রতিবাদ করে না। কলের পুতুলের মতন সব কিছু করে যায়।

দু-দিন বাদে সে শুনল, এইরকম অত্যাচারের জন্য চারটি ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে। কিন্তু আরও অত্যাচারের ভয়ে কেউ অভিযোগ করে না কর্তৃপক্ষের কাছে। প্রথম দিন। এসেই যে ছেলেটির সঙ্গে ইন্দ্রজিতের আলাপ হয়েছিল, তার হিস্টিরিয়ার মতন অসুখ দেখা দিল, সে পড়াশুনো ছেড়ে চলে গেল নিজের বাড়িতে।

ইন্দ্রজিৎ মনে-মনে সব সময় বলে, আমি যাব না। আমি কিছুতেই হেরে যাব না। বাবা-মা কিংবা চন্দনার কাছে আমি কোনওদিন এসব কথা বলতে পারব না। আমাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে।

ইন্দ্রজিৎ বাড়িতে চিঠি লিখল, মা, আমি খুব ভালো আছি। আমার জন্য কোনও চিন্তা কোরো না। এখানকার পরিবেশ যেমন চমৎকার, তেমনই এখানকার অন্য ছাত্ররাও আমাকে সব ব্যাপারে। সাহায্য করে। খাওয়া দাওয়া এত চমত্তার যে কী বলব তোমাকে…

দিন সাতেক বাদে ইন্দ্রজিতের মনে হল, হঠাৎ যেন একটা ঝড় থেমে গেল। সকাল থেকে একজনও তাকে বিরক্ত করতে আসেনি। গতকালও সত্যেনের সাইকেলটা তাকে কাঁধে করে নিয়ে যেতে হয়েছিল। আজ সত্যেন নিজে থেকেই তাকে ডেকে বলল, এই, আয়, আমার পেছনে বোস। রোদ্দুরের মধ্যে হাঁটবি কেন! একথা শুনেও ইন্দ্রজিৎ দাঁড়িয়ে ছিল, সত্যেন তার হাত ধরে টানল। সহাস্যে বলল, মুখ গোমড়া করে আছিস কেন? মেয়েটির ছবি নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি। হয়েছিল, ওসব মনে রাখতে নেই। ওরকম হয়েই থাকে।

কয়েকদিনের মধ্যে সত্যেন আর সেই মোটা ছেলেটা, যার নাম সুকুমার, এরাই ইন্দ্রজিতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে গেল।

এসব তো একুশ বছর আগেকার কথা। মাঝখানে নদী দিয়ে কত জল বয়ে গেছে। সেকেন্ড ইয়ারে ওঠার পর ইন্দ্রজিতের জীবনে হঠাৎ এক প্রবল ঝড়ের ঝাপটা লাগে। একবার না দুবার। বাবা তাঁর স্বপ্ন পূরণের ছবিটি দেখে যেতে পারেননি। এক রাত্রে ঘুমের মধ্যেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।

পারিবারিক বিপর্যয়ে ইন্দ্রজিতের পড়াশুনাই বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। টাকার অভাবে সে হোস্টেল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিল প্রায়। তখন এই সত্যেন, অনুপম, আর কয়েকজনই তাকে যেতে দেয়নি। জোর করে আটকে রেখেছিল। ওরা যে কতভাবে ইন্দ্রজিতকে সাহায্য করেছে, তা কি সে জীবনে কখনও ভুলতে পারে? অনুপমের কাকা আমেরিকান কনস্যুলেটে বড়

অফিসার। তাঁর সূত্রে অনুপম কয়েকখানা ইংরিজি বই অনুবাদের কাজ জুটিয়ে দিয়েছিল ইন্দ্রজিতকে। সেই টাকাতে সে পড়াশুনো চালিয়ে যেতে পারে শেষ পর্যন্ত।

আরেকটি ঝড়ে উড়ে চলে গেল চন্দনা। এক অচিন দেশের রাজকুমার এসে হরণ করে নিয়ে গেল তাকে।

আজকাল এইসব রাজকুমাররা আসে, বিলেত-আমেরিকা থেকে। এই রাজকুমারটি এল জার্মানি থেকে। সে যেমনই রূপবান, তেমনই তার পার্থিব যোগ্যতা। চন্দনার সঙ্গে আলাপের পরেই পঞ্চশরের কারসাজিতে দুজনের মধ্যে গভীর প্রেম হয়ে গেল। প্রেম তো আর যুক্তি কিংবা পূর্বপ্রতিশ্রুতি মানে না। কলকাতায় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর চন্দনা কাঁদতে-কাঁদতে অনুনয় করেছিল, সে ইন্দ্রজিতের কাছে মুক্তিভিক্ষা চায়। জার্মানি প্রবাসী যুবকটিই হবে তার। জীবনসঙ্গী। প্রায় নিঃশব্দে অনুমতি দিয়ে ইন্দ্রজিৎ উঠে চলে গিয়েছিল। এরপরেও চন্দনা দুটো চিঠি লিখেছিল তাকে। ইন্দ্রজিৎ উত্তর দেয়নি। ইন্দ্রজিৎ নিজেও চাকরি জীবনে কয়েকবার গেছে জার্মানিতে। কখনও চন্দনার খোঁজ করার প্রবৃত্তিও তার হয়নি।

প্রথম চাকরির সময় সত্যেন ছিল তার বস। ঠিক ছোটভাইয়ের মতন সাহায্য করেছে সে। বিভিন্ন সময়ে সুকুমার আর অনুপমের সঙ্গেও তার দেখা হয়েছে। প্রবল আচ্ছা, তাস খেলা ও পানাহারে। কেটেছে অনেক সময়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভরতির প্রথম কয়েকটি দিনের সেই ভয়াবহ। অভিজ্ঞতার বিন্দুমাত্র গ্লানিও তার মনে স্থান পায়নি।

শুধু অনুপমের দিকে সে মাঝে-মাঝে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেছে। এই অনুপম সম্পর্কে একটা প্রবল ঈর্ষাবোধ রয়ে গেছে তার মনে। এই অনুপম কত নিবিড়ভাবে চুমু খেয়েছিল চন্দনার। ছবিতে। আর ইন্দ্রজিৎ কোনওদিন আর চন্দনাকে আলিঙ্গন বা চুম্বনের সুযোগ পায়নি। এমনকী চন্দনার ছবিতেও না। এই অতৃপ্তি তাকে দগ্ধ করে চলেছে এখনও।


সমাপ্তঃ------- 

No comments

Powered by Blogger.